যারা বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র তাদের কারো সাথে কারোর লেখার তুলনামূলক আলোচনা করলে তাদের প্রতি অসম্মান হয়, সবার লেখার বিষয়বস্তু উপস্থাপনের বিষয়টি তাদের নিজের সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য প্রকাশ।আসলে সমালোচনা করা যত সহজ তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী কঠিন সাধনা করে তাদের কাজ সম্পর্কে জানা ও কাজের গভীরতা উপলব্ধি করা। কথায় বলে যে দেশে গুণীর কদর হয় না, সে দেশে গুণী জন্মায় না।বড় ব্যথা অনুভুত হয় যখন দেখি আমরা উনাদের নিয়ে টানাটানি করে উনাদের সম্মুখ যুদ্ধে নামাতে চাইছি। আরে ভাই, তারা দান করেছেন আমাদের মতো ভিখারীদের, তাদের জ্ঞানভিক্ষা পেয়েও যদি আমাদের মগজে
মানুষের জন্য মায়া তৈরী হয় তবে ঐ স্বর্গ থেকে ধরায় তারা পুষ্প বৃষ্টি করবেন, প্রমাণস্বরূপ আমাদের অন্তর পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠবে।
হুমায়ুন আহমেদ ও কাজী নজরুল ইসলাম দুজন দুই সময়ের মানুষ, তাদের উপস্থাপন ক্ষমতায়ও ব্যাপক পার্থক্য। সাহিত্য এক মহাসমুদ্র। দুই জন দুই সময়ে এ মহাসমুদ্রে সাঁতার কেটেছেন, জীবনকে দেখেছেন অনুভব করেছেন ভিন্নভাবে, বাংলা সাহিত্যে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।তাদের শব্দ ব্যবহার দিয়ে আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন, মেরুদন্ড সোজা করে সত্যের বাণী শোনানোর অসম সাহস যুগিয়েছেন, শব্দের কত অর্থ হয়, শব্দ যেন ছোঁয়া যায়, শব্দ যেন মনের গভীরের কথা সবার সামনে নিয়ে আসে, শিহরণ জাগায়,এক একটা চরিত্র শব্দের কারুকার্যে যেন জীবন্ত মানুষ হয়ে আমাদের সাথে কথা বলে, পরিচয় করায় কত অজানা কিছুর সাথে, অবস্হার সাথে, অবস্হানের সাথে, সমস্যার সাথে, সমস্যার সমাধানের উপায়ের সাথে, পছন্দের সাথে, পছন্দের গানের সাথে, প্রাণের সাথে, প্রাণবন্ততার সাথে, রক্ষণশীলতার সাথে, রক্ষণশীলতার ভেতরে লুকোনো কোমলতার সাথে, রক্ষণশীলতা আর আধুনিকতার পার্থক্যের সাথে, যুগ যুগের লড়াইয়ের সাথে, উত্তরণের সাথে, বিজয়ের সাথে, বিজয়ীদের সাথে, অসহায়দের সহায়ের সাথে, তাদের নির্ভরতার সাথে, হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখের সাথে – এতো বড় কাজ করে যারা নিজেদের শব্দের নিজস্বতায় বাংলা সাহিত্যকে
সমৃদ্ধ করেছেন তাদের জন্য চিরকাল অতল শ্রদ্ধা, তাদের
সম্বন্ধে কোন রকম সমালোচনার ধৃষ্টতা আমার নেই।
হুমায়ুন আহমেদ তার নুহাশ পল্লী সাজিয়েছেন সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য দিয়ে। সে সৌন্দর্য্য অনুধাবন করতে হলে ভাই শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লাগবে। আর হুমায়ুন আহমেদ শিল্প এবং শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন মানুষ ছিলেন। তার লেখা গল্প, নাটক আমাদের হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, সহজ সরল প্রশ্ন করে নতুন কিছু চিন্তা উপস্থাপন করা হুমায়ুন আহমেদের এক অসাধারণ গুণ ছিল।একজন লেখকের সাথে আরেকজন লেখকের লেখার তুলনা
করলে দুজনের প্রতি অসম্মান করা হয়।
কাজী নজরুল একজন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ ছিলেন। ধর্মের নামে অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক সোচ্চার কন্ঠ। নিজে বিয়ে করেছেন একজন হিন্দু মহিলাকে, সন্তানদের নাম রেখেছেন হিন্দু ও মুসলিম নামের মধ্যে ঐক্য করে। উনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখেছেন,
“খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!”
তিনি আরো লিখেছেন,
গাহি সাম্যের গান,
যেথা আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীস্টান।
তিনি আরো বলেছেন,
সবার উপর মানুষ সত্য
তার উপরে নাই।
কিন্তু আমরা বার বার কেন আমাদের সংকীর্ণ চিন্তা দিয়ে এত বড় মাপের মানুষদের যার যার সিন্ধুকে ভরে নিজের সম্প্রদায়ের মান বাড়াতে চাই যাদেরকে এই আমরাই তাদের জীবদ্দশায় কাফের বা নাস্তিক খেতাব দিয়ে দিয়েছি।হায় রে।
তাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা ছিল না, দুজনেই বিনয়ী মানুষ ছিলেন। নজরুলের বিদ্রোহী ভাষা যেমন আমাদের অন্যায় দেখলে শক্তি জাগায় তেমনি হুমায়ুন আহমেদের কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই এর ফাঁসী আমাদের কাঁদায়, রেগে মেগে মানুষ তার বাড়ীও ভাঙ্গতে যায় তখন।কত অসামান্য শক্তি আর মেধা থাকলে তার নাটকের একটি চরিত্রকে তিনি আমাদের আপনার আপন করে তুলতে পারেন, টেনে এনে বসাতে পারেন টিভির সামনে, কৌতুহল জাগাতে পারেন কি হয় কি হয়? সহজ সাবলীল ভাষায় মানুষের মন জয় করেছেন হুমায়ুন আহমেদ।
সময় ভিন্ন হলেও এরা বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারের যাদুকর। তাদের শব্দের মায়াবী যাদু দিয়ে দুজন দু সময়ে রাজত্ব করেছেন, বর্তমানেও করছেন নয়তো তাদের নামের কাসিদা আমরা কেন পড়ছি, এই মহারথীদের নামে এ লেখা দিয়ে আমিই বা ফেইসবুকের ওয়ালে আঁচড় কেন দিচ্ছি? আজ একটি সামান্য কথা বলতে চাই, শ্রদ্ধা শব্দটা এত আজব সেটি আপনার সঙ্গে যখন থাকবে হাজার মানুষের মনে সে আপনার জন্য জায়গা বানাবে, আর যারা প্রকৃতই শ্রদ্ধা পাবার কাজ করেছেন,
তাদের শ্রদ্ধা করার গুণ মানুষের মনে আপনার শ্রদ্ধা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
তাই বলছি, হুমায়ুন ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দিকপাল।
তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়ে কাবাডি খেলানো আদতে ঠিক হবে না এতে তাদের সম্মান আরো বেড়ে যাবে। যিনি ভুলবশতঃ এমন করে ফেলবেন, মানুষ অবাক হয়ে বলবে, হা হা বলে কি?
সম্মান তাদের প্রাপ্য অধিকার। তাই আজ এক মহাবিশ্বের সম্মান
আমি বাংলা সাহিত্যের সব আমলের সব লেখকদের এবং বাংলা সাহিত্যের সাথে যে কোন ভাবে যুক্ত সাধকদের দিলাম।
বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হোক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি তাদের প্রতি আজীবন গভীর শ্রদ্ধা জানাই।