(অহনাদের অফিস পিকনিক)
পর্ব – ১৪
প্রসন্ন ভোর। আকাশ পুরোপুরি নির্মেঘ। দু’চারটা শিমুল তুলোর মতো মেঘের স্তুপ আকাশে ভাসছে বেখেয়ালে। হঠাৎ উপর পানে তাকালে আকাশ কে বড় মায়াবী লাগে। যেন একটা নীল ক্যানভাসে কেউ তুলির আঁচড় কেটেছে। ঘুম জড়ানো নিস্তব্ধতা রাস্তায়। ছুটির দিন বলেই হয়তো শহুরে মানুষের ওত কোলাহল শুরু হয়নি এখনো। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসছে। সাদা মেঘ, নীল আকাশের চালচিত্র প্রায় বকের পাখার মতো ধবধবে সাদা। ওই মেঘ বলে দেয় আকাশের আর কান্না নেই। মিরপুর রোডের বিশাল চওড়া রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম আমি আর অহনা। মেট্রোরেলের জন্য রাস্তাটা সংকীর্ণ করায় এরাস্তায় গাড়ীঘোড়া বড্ড জোরে চলতে পারে না। তাই রাস্তাটা পেরুনোও সহজ। আজ অহনার অফিসের অ্যানুয়াল পিকনিক। দাওয়াত পড়েছে আমারও। সাড়ে সাতটায় রিপোর্ট করতে হবে ওর অফিসের সামনেই। গেটের কাছে কাউকে প্রতীক্ষায় থাকতে দেখা গেল না। আমি আর অহনা একাই ঢুকলাম অফিসের গেটে। ওদের গেটের ভেতর একটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। আমি আনমনে শিউলী গাছটার দিকে তাকালাম। ফুলহীন গাছটাকেও বড় নিরানন্দ দেখাচ্ছে এখন। সকালের স্বল্প আলোতে গাছটা যেন ঝিমাচ্ছে। ফোঁস ফোঁস শ্বাস ফেলছে।
দু’একজন করে লোকজন আসতে শুরু করেছে। অহনা নিচে ওয়াচম্যান কেবিনে বসে হাই তুলছে। একটুখানি কটমট করে দেখল আমাকে।
সকালে অহনার ঘুমের রেশ থাকে অনেকক্ষণ আর আজকে তো ভোরে উঠেই তৈরী হতে হল। রাতের পোশাক পাল্টে কালো রংয়ের নতুন সালোয়ার কামিজ পরে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল উল্টে খোঁপা করল। টুকটাক প্রসাধনী মেখে, লিপস্টিক আলতো বোলাল ঠোঁটে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব সুন্দর থেকে সুন্দরতর হচ্ছে। জানলা দরজা পরিপাটি বন্ধ করে দরজা টেনে তালা ঝুলিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়েই বলল, ব্যাগ নেয়া হয়নি।
অহনা ওয়াচম্যান কেবিনে বসতেই আমি বাইরে এলাম। পুব আকাশে গোলাপী আভা। মাথার ওপর আকাশ প্রায় বর্ণহীন এখন। কৃঞ্চপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ কানা ভাঙ্গা থালার মতো ফুটে আছে আকাশে। দীপ্তিহীন, দ্যুতিহীন অদ্ভুদ এক ধুসর চাঁদ। আড়ষ্ট ভাবে আমি দাঁড়িয়ে আছি অহনার অফিসের সিঁড়ির গোড়ায়। ওর অফিসের মাহবুব সাহেব এলেন বউ বাচ্চা নিয়ে। অহনার দিকে তাকিয়ে বলল কেউ আসেনি? অহনা আমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি আড়ষ্টভাবে তাকিয়ে হাসলেন, আমার সাথে হাত মেলালেন। অথবা হাসলেন না, অজান্তেই ফাঁক হয়ে গেছে ঠোঁট। সে যাই হোক। পরিচিত কাউকেই দেখছিনা। প্রাথমিক বিরক্তি কাটিয়ে হাসি হাসি মুখে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে এলো রফিক ভাই, জাকারিয়া সাহেব, মাহফুজ সাহেব তার পরিবার, ফারুক সাহেব তার মেয়ে, দুলাল সাহেব তার পরিবার। আমার সাথে আজকেই প্রথম দেখা উনাদের। গাড়ীতে উঠে বসলাম। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। যেন ঘরের ভেতর অচেনা পাখিরা দুর্বোধ্য ভাষায় কিচির-মিচির করছে। রাস্তা বেয়ে বাস রিকশা ছুটে যাচ্ছে, চর্তুদিক ধোঁয়াটে, জমাট বাষ্পের পর্দায় ঢাকা যেন। গাড়ী এগুচ্ছে অল্প অল্প করে। গাড়ীতে উঠে বসল ফয়সাল ভাই আর তাঁর ওয়াইফ। ফয়সাল ভাইয়ের মেয়েটা দেখতে বেশ হয়েছে। এক মাথা ঝাকড়া চুল, পুতুল পুতুল মুখ, টুকটুকে রঙ।
স্বর্না আপা আর উনার হাজবেন্ড আশরাফুল ভাই গাড়ীতে উঠবেন বসুন্ধরা কনভেনশনের সামনে থেকে। আব্দুল্লাহ ভাই আর উনার স্ত্রী আফসানা ভাবী হয়তো পরের গাড়ীতে আসছেন। সে গাড়ীতে আছে জাকারিয়া সাহেব, মাজহার সাহেব সহ অন্যরা। ভোরেই স্পটে চলে গেছেন বাল্যবন্ধু জিয়া এবং এনায়েত সাহেব।
আমাদের গাড়ী চলতে শুরু করেছে। ছুটির দিনে আজ ঢাকা বড় সুন্দর সেজেছে। সূর্যের প্রথম আলো সিঁদুর-গোলা রঙ ঢেলেছে রাস্তায় রাস্তায়। ঢাকার বাড়ীগুলোর গায়ে সেই অপার্থিব রঙ। বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল স্বর্ণা আপু আর আশরাফুল ভাই, মুখে অপ্রতিভ হাসি। উনারা উঠে বসলেন। গাড়ী চলছে। অহনার চুল থেকে মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। অভিজাত মহিলাকে ভিখিরি যেমন দেখে তেমনই অহনার দিকে চেয়ে আছি আমি। পুরুষ মানুষ বুঝি এরকমই বহুকাল থেকে। নারী ছাড়া কে তাকে শেখাবে নারী প্রেম, হাঁটু গেড়ে প্রেমভিক্ষা মোলায়েম ভালোবাসার কথা। কাঞ্চন ব্রিজে এসে একটু বুঝি খটকা। জাকারিয়া সাহেব কে ফোন করে সে খটকা দুর করা হলো। ব্রিজ কে পাশ কাটিয়ে চলছে বাস। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় বাসের ইঞ্জিন গোঙাতে গোঙাতে চলছে। দু-ধারে গাছ গাছালি, রাস্তার লোকজন অবাক তাকায়। এক-আধটা দোকান খদ্দেরহীন, বসে আছে দোকানী। চায়ের দোকানে দু,একজন বসে পান করছে কষটে চা। রাস্তার দু’ধারে ফাঁকা জমিতে দু’একটা বাড়ী চোখে পড়ে। নাবাল মাঠ শুকনো খটকটে। আঁকাবাঁকা পথে গাড়ী ঘোরে। আমার ফুসফুস নিকোটিনের স্বাদ পেতে চাইছে ম্যালা সময় ধরে।
সবাই নেমে গেল পিকনিক স্পটে। ঘুরে ঘুরে দেখছে।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। নিবিড় ছায়া এখানে। পায়ের নীচে ঘাস, পাতা! নির্জনতা? জিয়া ছুটে এলো। তার পেছন পেছন ছুটে এলেন ফরসা, মজবুত চেহারা, লম্বা চৌকো মুখ, খাকী রঙ্গা সরু চাপা প্যান্ট আর টি শার্ট পরিহিত এনায়েত সাহেব। লোকেশনটা অনেকটা অবকাশ বাড়ীর আদলে করা। একটা ছোট পুকুর, লাগোয়া ফলের বাগান শান বাঁধা একটা ঘাট, ছোট ছোট করে কয়েকটা বিশ্রাম খুপড়ি, ঢালাই রাস্তা পার হলেই ডুপ্লেক্স বাড়ী।
সকালের নাস্তা ভূনা খিচুড়ি আর ডিমের কোরমা, ডুপ্লেক্স এ সবার জিনিস পত্র রেখে সবাই নাস্তার টেবিলে। প্যান্ডেল মতো জায়গায় খাবার আয়োজন। অহনাদের অফিসের পুরাতন স্টাফ কবির ভাই হারমনি, তবলা আর বাদ্য বাজনা নিয়ে ভালোই আবিষ্ট করে রেখেছেন বাচ্চাদের। বাচ্চাদের খেলাধুলা, ভাবীদের নিয়ে পিলোপাস, আর পুরুষদের ফুটবল। দুপুরে খাবার মেজবানী গরুর মাংস, চিকেন রোস্ট, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, শিম ভর্তা, টমেটো ভর্তা, বোরহানী আর দই।
দুই আফসানা ভাবীকে নিয়ে অহনা আর আমি বসে আছি নরম রোদে। আফসানা ভাবীদের নামের সাথে রুপের খুব মিল। নামেও আফসানা রুপেও আফসানা। দুজনকেই বেশ জলি এবং আন্তরিক মনে হলো।
সায়মা আপা উনার হাজবেন্ডকে খুব ভালো লেগে গেল। ফুটবল খেলতে গিয়ে বেচারা মারাত্মক ভাবে আঘাত পেলেন। আনন্দের সাথে বেদনার অনুভূতি।
স্বর্ণা আপু আর আশরাফুল ভাই তো সবসময়ই আমার ভালোলাগার মানুষ।
মিস করেছি জিয়ার বউ কে আর সোলাইমান সাহেব কে। সন্ধ্যায় র্যফেল ড্র আর সায়মা আপুর হাজবেন্ডের নির্দেশনায় পরোটা আর বারবিকিউ। আতজবাজি আর ফানুস উড়িয়ে নিজেদের একটা আনন্দ উল্লাসে কেটে যাওয়া একটা দিন। আহ সময়টা যদি অনন্ত হতো? গাড়ীতে উঠে বসতে বসতে টের পেলাম মানুষ কত অসহায়, সময়ের লাগাম মানুষের হাতে যে নেই। ধন্যবাদ অহনার অফিস কে। ধন্যবাদ অহনার কলিগদের। ধন্যবাদ ভাবীদের।
আমার স্মৃতির ঝোলা আর একটু ভারী হলো বুঝি। জীবনের কোন এক সময় অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে হয়তো ভাববো আজকের দিনটা।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট