পর্ব-১৫
আজন্ম ভালোবাসা নামক এক মিথ্যে মরীচিকার পিছে ছুটেই গেছি কেবল, ভালোবাসা নামক সুখ পাখির খোঁজে আমি বিশুদ্ধ পরিব্রাজক হয়ে ছুটে বেড়িয়েছি অর্ধেক পৃথিবী। সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করা মানুষ গুলো ভালোবাসার নামে ঠকিয়েছে আমায় কেবল।
সর্বস্ব উজাড় করে যাদের ভালোবেসেছি তারা কোনদিন কোনকালে আমার আবেগের সম্মান বা শ্রদ্ধা করেনি কোন কালে। ভালোবাসার কাঙাল হয়ে কেটেছে আমার শৈশব, কিশোর, তারুণ্য, যৌবন।আজ পৌঢ়ত্ব আমার জীবনের দরজায় কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে তবু আমি খুঁজে চলেছি বিশুদ্ধ ভালোবাসার অস্তিত্ত।
আজ এত কাল যেটাকে আমি ভালোবাসা ভেবে পুলকিত হতাম, হঠাৎ কেন যেন মনে হচ্ছে তা কখনোই ভালোবাসা ছিল না, ছিল প্রয়োজন অথবা অবলম্বন, কারো আইডেনটিটির প্রয়োজনের বলি হয়েছিলাম কেবল আমি।
আমার শৈশবের প্রেম নতুন বইয়ের পাতার গন্ধ শৈশবের সাথে সাথে আমায় ছেড়ে গেলো, টেরই পাইনি। কৈশোরের প্রেম নিশিত হারিয়ে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই আর আমার উচ্ছল তারুন্যের প্রেম রিমি, ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিলো তার প্রান, ভালোবাসা বুঝার আগেই আমি একা হয়ে গেলাম। সেই একাকীত্বের খোলস ভাঙ্গিনি অনেকটা সময় অনেকটা কাল। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম শামুকের মতো নিসঙ্গতার খোলসে। ভাঙতে চাইনি অনেক দিন।
কিন্তু একদিন একজোড়া চোখ, একটা বোতল গ্রীন শাড়ী পড়া এক নারী ঢুকে পড়লো খোলসে বন্দী থাকা আমার বরফ শীতল হৃদয়ে।
ভালোবাসা ছিলো না প্রেম ছিলো বুঝিনি। কিংবা বুঝতে পারিনি। সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম আমি, সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে বুঝেছি আমি তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছি কিংবা সে আমার অভ্যাসে।
শীর্শেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা বইতে পড়েছিলাম, বেশীদিন বেঁচে থাকলে মানুষকে ভারী একা হয়ে যেতে হয়। আসলেই কি তাই?
একটা গরম বাতাস আলগা ভাবে বয়ে গেল বুকের ভেতর দিয়ে। কত সযত্নে যে লালন করছি বুকের ক্ষতগুলো। হৃদয়ে অহর্নিশি জ্বালাপোড়া। টুক করে রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। গত রাতে গা জ্বালা জ্বালা করছিল। আমাদের দু’কামরার ফ্ল্যাটে একটাই লাগোয়া বাথরুম। বাথরুমে যেতে হয় রুম ছেড়েই।ফ্ল্যাটটা এমনিতে চমৎকার। দোতলার ওপর। পুব- দক্ষিন খোলা। অঢেল হাওয়া। অঢেল আলো। অঢেল প্রেম আমাদের। গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে অহনা। কামরায় জেগে আছে নীলচে রাতবাতি। রাত এখন বড় মায়াময়। চাঁদের বুড়ি রুপোলী সুতো কেটে চলেছে চরকায়। সেই সুতোয় বোনা মসলিন এখন ভাসছে বাইরে। জোস্না হয়ে।
কাল ভোরে অহনার আম্মা চলে যাবে। অহনা আর আমি দুজনেই ফ্লু সংক্রমিত হয়েছিলাম। তাই ছুটে এসেছিলেন।
গত পরশুদিন চেম্বারে এক অদ্ভুত রোগী এলো। ওয়াইফ হাজবেন্ডকে মেরেছে আর হাজবেন্ড ওয়াইফ কে। পুরুষ রোগীকে জিজ্ঞেস করলাম কী নিয়ে ফাটাফাটি হলো? ভদ্রলোক তখনি বলল, আমি যে ওকে খুন করিনি এ ওর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। কী অসভ্য মেয়েছেলে জানেন? জম্পেশ ঘুমাচ্ছিলাম রাতে, ওই বজ্জাত মেয়ে আমার ঘুমন্ত নাকে ফস করে ড্রপ দিয়ে দিলো। ওই তেতো ন্যাজাল ড্রপ যদি আমার শ্বাস নালীতে ঢুকে যেত? বসে বসে ফোঁস ফোঁস করছে ভদ্রলোক, লাল চোখ ঘুরছে এপাশ – ওপাশ। ভদ্রমহিলা বললেন, কী অসম্ভব বিশ্রী করে মুখ ডাকছিল নাক বন্ধ হয়ে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল তাই ন্যাজাল ড্রপ দিয়ে দিলাম। উপকার করলাম আর অম্নি উঠে আমাকে মারতে শুরু করলো। আমিও খামছে দিয়েছি। আমি বললাম, না না এটা ঠিক করেন নি। ঘুমের মধ্যে ন্যাজাল ড্রপ? ভদ্রমহিলা এমন ভাবে তাকালেন যেন মনে হলো আর বেশী কথা বললে এক্ষুনি আমাকেই বুঝি খামচে দেবেন।
অ্যাদ্দিনে এইটুকু অন্তত বুঝে ফেলেছি দুনিয়ায় মেয়েরা একটা আলাদা জাত। একটা স্পেসিফিক স্পিসিস। একটা কাককে একটু বেঁধে রাখলে সব কাক যেমন এক সঙ্গে কা কা করতে থাকে, মেয়েরা ও যেন অনেকটা সেরকম। আমি আর না ঘাঁটিয়ে চিকিৎসা দেয়ায় মনোনিবেশ করলাম।
খোলা দরজার দিক থেকে ফাল্গুনি বাতাস আসছে। ঘরের পর্দাগুলো দুলে উঠছে সে বাতাসে। বাইরের আলোর ঝলকানি ঘরে ঢুকে মৃদু জ্যোতি। আহ্লাদী বাতাস ছুটছে টালমাটাল। বসন্তের দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভারী আরাম লাগছে। চোখ বুঝে অহনাকে চোখে আনলাম। অহনা এখনও বড্ড ছেলেমানুষ। বাচ্চা মেয়ের মতো কারণে – অকারনে হাসি, কথায় কথায় অভিমান, একটুকুতেই খুশী, দ্যাখ না দ্যাখ চোখ টলটল। অহনাই তো আমাকে প্রথম নিজেকে ভালোবাসতে শেখাল, নতুন করে স্বপ্ন দেখাল, জীবনের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনল আবার। অহনাই যে এখন আমার সব থেকে বড় আশ্রয়।
অনেকক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরালাম। নীলচে সাদা ধোঁয়া ঘন থেকে পাতলা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চর্তুদিকে। এমুহূর্তে একটা গভীর স্পর্শ কামনা করছে আমার মন। একটা হাতকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
আচ্ছা প্রেমিকা বউ হলে কি তাই হয়? আমি জানিনা। এখন আমাদের মাঝে চৌদিকে ঝুলে থাকে ভালোবাসার মৌমাছিপুঞ্জ। বয়সের সাথে কি ভালোবাসারা ও বুড়ো হয়? আশংকা মেঘে কি ঢেকে যায় মন? আচমকা ভালোবাসার মানুষটাকে কি অচেনা লাগে?
আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল আমি ভালোবাসার অসম্ভব সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে ছুয়ে প্রহর গুনি অনন্ত যাত্রার। যার কবরের এপিটাফে লেখা থাকবে, ভালোবাসার অসম্ভব সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে ছুয়ে ফেলার পর মরে যাওয়া ছাড়া আর কী চাওয়ার বাকী থাকে মানুষের জীবনে? কখনো কোন প্রেমিক যুগল আমার কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় থমকে দাঁড়াবে, আর খুব সযতনে রাখবে একটা না ফোটা গোলাপ কুঁড়ি।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট