1. fauzursabit135@gmail.com : Fauzur Rahman Sabit : Fauzur Rahman Sabit
  2. sizulislam7@gmail.com : sizul islam : sizul islam
  3. mridha841@gmail.com : Sohel Khan : Sohel Khan
  4. multicare.net@gmail.com : অদেখা বিশ্ব :
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪১ অপরাহ্ন

একুশের চেতনা, নতুন প্রজন্ম ও শহীদ মিনার

ডা. মোজাহিদুল হক
  • প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
কাল চক্রে আমাদের শোকের ধরন ও পাল্টে গেছে। শহীদ মিনারে জুতা পায়ে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা দেখে আমার কাছে তা মনেই হয়নি আমরা শোক জানাতে গেছি ।গাম্ভীর্যতার লেশ মাত্র চোখে পড়েনি। একুশের চেতনা কি ছিল? কি ছিল একুশ? সবচেয়ে হতাশা ভিড় করে যখন দেখি একুশ নিয়ে গবেষনা বা পড়াশুনা করার মতো পর্যাপ্ত বইয়ের প্রচুর অভাব। প্রতি বছর একুশে বইমেলা হয় ঠিকই কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে কয়টা বই বেরোয়? আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের বাঙ্গালী জাতির এক গৌরব উজ্জল ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস।আরো অবাক হই একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে নতুন প্রজন্মের জ্ঞাণের সীমাবদ্ধতা দেখে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাঙ্গালী জাতি সত্ত্বার উপর পাকিস্তানী দের প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৭ সালের ১৯শে মে মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামানের সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদের ঘোষনা যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।
সে সময় তার ঘোষনার বিরুদ্ধ কোন প্রতিবাদ উঠেনি।
১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গনতান্ত্রিক যুবলীগের এক সম্মেলনে বাংলা কে শিক্ষার সরকারী ভাষা করার দাবী করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস এক পুস্তিকায় বাংলাকে পুর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারী ভাষা, উর্দুকে আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা এবং ইংরেজীকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে গ্রহনের দাবি জানানো হয়।
এতদসত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সুপারিশ করা হয়। এখানেই ভাষা নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি।
১৯৫১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যায় বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের শতকরা হার ছিল :
বাংলা ৫৬.৪০% পাঞ্জাবী ২৮.৫৫% পশতু ৩.৪৮% সিন্ধী ৫.৪৭% উর্দু ৩.২৭% বেলুচি ১.২৯ % ইংরেজী ০.০২%। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি একটি অভিন্ন ধর্মের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। আশা করা হয়েছিল যে ইসলাম শুধু বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যেই সম্পর্ক জোরদার করবে না বরং সমগ্র রাষ্ট্রের একক জাতীয় বৈশিষ্ট্য গঠন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর সৃষ্ট ঘটনাবলীতে এই আশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এসব ঘটনাই বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী দের বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। বাঙ্গালীদের এই মোহমুক্তিই তাদের মধ্যে প্রবল আঞ্চলিকতার জন্ম দেয় যা শেষ পর্যন্ত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে রুপ নেয়।
মুলতঃ ভাষা বিরোধের সুত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আইন পরিষদে খসড়া কার্যপ্রণালী বিধি গ্রহন সম্পর্কিত বিতর্কের সময় এই বিধিতে পরিষদের সদস্যদের ইংরেজী বা উর্দুতে বক্তৃতা করার অনুমতি দেয়া হয় সরকারী ভাষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। এ সময় পূর্ব বাংলার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কার্য প্রনালী বিধির সংশোধনী উত্থাপন করে ইংরেজীও উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্তভূক্ত করার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, আমি পরিষদকে আশ্বাস দিতে পারি যে,সংকীর্ণ প্রাদেশিক চেতণা থেকে আমি এটা করছি না, জনাব, আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, এটা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ভাষা এবং বিভিন্ন ভাবে তা প্রতিষ্ঠিত। এজন্য রাষ্ট্রের ভাষা সেটিই হওয়া উচিত যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন কতৃক ব্যবহৃত হয় এবং জনাব এজন্য আমি বাংলাকে আমাদের দেশের যোগাযোগের অন্যতম ভাষা হিসাবে বিবেচনা করি। (CAP Debates vol-11 (february 25. 1948)PP.17-46.
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তার সমাপনী ভাষনে উর্দুকে পাকিস্তানের যোগাযোগের ভাষা হিসাবে গ্রহনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষনা করেন। আইন পরিষদের এই বিতর্ক থেকেই ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। ছাত্র শিক্ষক সংবাদপত্র সাময়িকী এবং পূর্ব বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিরা গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা হরতাল আহবান করে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে বাংলাকে সরকারী ভাষা করার আন্দোলন জোরদার করা হয়। ২ মার্চ একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এতে পিপলস ফ্রিডম লীগের ২জন, তমদ্দুন মজলিস থেকে ২জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ২জন, ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ২জন পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ২জন প্রতিনিধি নেয়া হয়। কার্যত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৪৮ সালের ১১মার্চ ভাষা আন্দোলন সহিংস রুপ নেয়। এদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সাধারন ধর্মঘট পালিত হয়। এ সময় বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা প্রদানের দাবীতে পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ের বাইরে সমবেত ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠি চার্জে প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্র জখন হয়।
ছাত্রদের অব্যহত আন্দোলনের ফলে খাজা নাজিমুদ্দিন আতংকিত হয়ে পড়ে। এদিকে ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ স্বাধীনতার পর প্রথম জিন্নাহর ঢাকা সফরের কথা ছিলো। এবিবেচনায় নাজিমুদ্দিন ১৫ ই মার্চ রাষ্ট্রীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে আলোচনায় সম্মত হন। এবং আট দফা চুক্তি সই করেন।
চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র দুইদিনের মধ্যেই নাজিমুদ্দিন মত পরিবর্তন করেন এবং পূর্ববাংলা পরিষদ ভাষার প্রসঙ্গটি বেমালুম ভুলে যান। ছাত্ররা নতুন করে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং ফাঁকা গুলীবর্ষন করে।
কায়দে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বৈরাচারী। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দান ও ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুই রাষ্ট্রের যাোগাযোগের ভাষা হবে বলে ঘোষনা দেন সমাবর্তনের গ্রাজুয়েট রা বক্তৃতা শোনেন কিন্তু না না বলে কয়েকবার বক্তৃতার মধ্যে বাধা দেন। কায়দে আযমের এই ঘোষনার ফলে পুর্ববাংলায় ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেয়।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জন্য গর্বিত বাঙ্গালীরা তাদের ভাষার অধিকার রক্ষায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এভাবে ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক প্রভুত্ব, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরিণত হয়।১৯৫২সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় বলেন উর্দু অবশ্যই দেশের যোগাযোগের ভাষায় পরিনত হবে। ৩রা ফেব্রুয়ারী ছাত্র ও বুদ্ধিজীবি সমাজ ক্রোধে ফেটে পড়ে।
৩১ জানুয়ারী গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি সমগ্র পুর্ববাংলায় হরতালের ডাক দেয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে বিশাল বিক্ষোভ কর্মসূচীর ঘোষনা করে। পূর্ববাংলা আইন পরিষদের অধিবেশন থাকায় ঐদিন বিক্ষোভ প্রদর্শনের সুবিধা হিসাবে চিন্তা করা হয়। সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারী রাতে পরবর্তী একমাসের জন্য CRPC এ্যাক্টের ১৪৪ ধারা জারী করে।প্রকাশ্যে চারজনের বেশী একত্রিত হওয়া নিষিদ্ধ করে।সরকারের এই কৌশলে ছাত্রদের মনোভাব শক্ত হয়ে যায়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়।
সেই একুশে ফেব্রুয়ারী সকাল যে দেখেনি তার পক্ষে ঐদিনের সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সেদিন ঢাকা শহরকে জনহীন প্রান্তর মনে হয়েছিল। সকাল আটটার পর ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকে। যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন উপচেপড়া অবস্থা তখন ১০ জনের গ্রুপ করে ছাত্রদের ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মাত্রই প্রত্যেক গ্রুপকে গ্রেফতার করে। এক পর্যায়ে আটক ছাত্রদের সংখ্যা বেড়ে তা পুলিশের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তখন পুলিশ কাঁদানো গ্যাস ব্যবহার করে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে, ছাত্ররা এলোপাতাড়ি দৌড়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে যায়। সেখানেও একই পরিস্থতির সৃষ্টি হলে পুলিশ ছাত্রদের প্রতি গুলী ছোড়ে। এভাবে শহীদ হন সালাম, রফিক আবুল বরকত ও জব্বার প্রমুখরা।
গুলী বর্ষনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাংলাকে অন্যতম জাতীয় ভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করেন (ref. East Bengal legislative Assembly. Official Report vol. VII (February 22 1952) p. 89.
সেই থেকেই বাংলাদেশে শোক , ত্যাগ ও দৃঢ় সংকল্পের দিন হিসাবে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালিত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হওয়ায় তা আমাদের প্রতিদিন নতুন করে তাঁদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যারা তাদের আজ কে আমাদের আগামী কালকের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন।
ভাষা শহীদদের স্মরণে ছাত্ররা রাতারাতি কোদাল, ইটটও বালি দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের যেখানে গুলী হয় সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে যা শহীদ মিনার হিসাবে পরিচিত। ২৩শে ফেব্রুয়ারী শহীদদের একজনের মা ও বাবা এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ পাক সৈন্যরা স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে।
এতো বড় ত্যাগ শোক আর সংকল্পের দিনে সত্যি কি আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরন করতে পারছি? নাকি ভূলতে বসেছি তাঁদের মহান ত্যাগ? সারা বছর অরক্ষিত শহীদ মিনারের যথাযথ হেফাজত। শহীদ মিনার যে কেবল সিমেন্ট ইটের কোন স্থাপনা নয় এটা যে আমাদের প্রচন্ড আবেগের এটা নতুন প্রজন্ম কে অনুধাবন করানো আবশ্যক। ©

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট

Theme Customized BY LatestNews