পর্ব- ১৭
ফাল্গুন আসতে না আসতেই এবার ঝুপ করে চলে গেল শীতটা। প্রায়দিনই এখন মেঘ করে থাকে,তবে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা ও নেই। সৃষ্টি ছাড়া এই মেঘের পল্টন কোত্থেকে যে এল! লাভের মধ্যে লাভ রোজ বাজারে সবজিঅলারা শাসাচ্ছে এরকম চললে সবজির দর নাকি বেড়ে যাবে তিন চার গুণ। ঘরে ঘরে অসুখ বিসুখ ও বেড়েছে হঠাৎ। সর্দি কাশি জ্বর।
অহনার অফিস পিকনিক তাদের নারায়নগঞ্জের ফ্যাক্টরীতে। সকাল সকাল উঠে ও বেরিয়ে গেল। অহনা চলে যাবার পর কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। নিরালা সকাল।
প্রতিদিন যে সকালটা কচ্ছপের পিঠ হয়ে মড়ার মতো চোখের সামনে পড়ে থাকে, সেটা যেন কোন জাদুতে অলিম্পিকের দৌড়বীর হয়ে গেল। এক লাইন লিখি, আবার কাটি, আবার লিখি আবার কাটি। কাটাকুটির খেলা খেলছি মনে হয়। ব্রক্ষ্মতালু জ্বলতে লাগলো রাগে, তবু কলমে বাক্য আসছে না।
লেখা কি সহজ কাজ? সন্তান গর্ভে ধরার মতো ধারন করো চরিত্র গুলো কল্পনার সাথে বাস্তবের সঙ্গম ঘটিয়ে জন্ম দাও লেখার। হৃদয় মন বুদ্ধি দিয়ে রক্তমাংসে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করো, ভাষার কারুকার্যে বাঁধ তাদের, এ এক শরীর নিংড়ানো সাধনা।
রোদ্দুরের তাত বেড়েছে খুব। রাস্তায় বেরুলেই ঝাঁ করে গায়ে হল্কা লাগে, যেন অতিকায় এক তোলা উনুন প্রকৃতিময় আঁচ ছড়াচ্ছে। গত রাতের কেনা সিগারেট শেষ হয়েছে। নতুন করে কেনার জন্য বেরিয়েছি। সিগারেটে টান দিলে জট পাকানো লেখার জট যদি খোলে। নাকি নির্জনতার ছটফট কাটাতে এ এক বাহানা।
ফোনটা বাজছে। একটানা বেজেই চলছে। ফোনটা ধরতে এসে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেছে। অস্থির পায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। বেলা গড়াচ্ছে। পায়ে পায়ে পিছু হঠছে রোদ্দুর। রোজ এ সময় অহনা লাঞ্চ আওয়ারে বাসায় আসে। নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দু’দন্ড। রোজ এ সময়টায় আমার চোখ জোড়া দরজায় স্থির থাকে। আজ বার বার কেবল সেদিকেই নিবন্ধ হচ্ছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এক কাপ চা করে খেলে মন্দ হতো না। এই এক বছরে এই প্রথম অহনা দুপুরে বাসায় এলো না। অহনা না থাকলে একা একা আমার খিদে লাগে না। আজ ও লাগছে না। কয়েকদিন ধরে শীমের বীজ দিয়ে ছুরি মাছের শুকটি খেতে খুব মন চাইছে।
রোদ্দুরের আজ খুব মন খারাপ। পশ্চিম আকাশে পৌঁছে ও গল গল তাপ ছড়াচ্ছে সূর্য।
অহনা নেই বলে আমার মন খারাপ নয়। লোকে ভাবে অহনা চাকরি করছে নিজের স্বাধীন জীবন। স্বাধীন জীবন…. ঘোড়ার ডিম। চাকরী করা মেয়েদের পায়ে শিকলটা আরও শক্ত করে বাঁধা থাকে। সকাল থেকে কুকুরের মতো দৌড় মারো, রান্না দেখো, বরকে খাওয়াও, তারপর নাকে মুখে গুঁজে যুদ্ধ করতে করতে অফিস দৌড়াও। কনটিনিউয়াস ব্যালান্স। আহা বেচারী এই একটা দিন না হয় মন খুলে একটু স্বাধীনতা ভোগ করুক।
আমার এক বান্ধবী একদিন হাসতে হাসতেই আমায় বলেছিল দুনিয়ার সব বর নাকি এক ছাঁচে তৈরী।কোন বরই নাকি তার স্ত্রীর স্বাধীনতা দিতে চায় না। একটা বর থেকেই নাকি জেরক্স হয়ে লাখে লাখে কোটিতে কোটিতে বর বেরোতে থাকে। এটা নাকি সার্বজনীন সিস্টেম। আমেরিকার, চীন জাপানের গুলোও নাকি এমন।
আমি হাসতে হাসতে বললাম আমি মোটেও ওই ছাঁচের নই। ও হাসতে হাসতেই বলল, আমি নাকি জেরক্সের ডিফেকটিভ কপি। জেরক্স মেশিনে তেড়া বেঁকা, কিংবা কালি কম বেশী হলে যে কপি গুলো ফেলে দেয়া হয়, সেরকম। ওই ডিফেকটিভ কপি গুলোই নাকি সব লক্ষী বর। আমিও নাকি সে রকম।
খোলা জানালা দিয়ে লাজুক লাজুক বাতাস আসছে মাঝে মাঝে।
ইদানিং প্রচুর উদ্বেগ হয়। উদ্বেগেরও কি প্রান আছে? প্রাণীদের মতো তার রুপভেদ ও কি অজস্র? হয়তো। এই কখনো কখনো উদ্বেগ গুলো তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। কখনও বা একছিটে মেঘ হয়ে দেখা দেয় মনের আকাশে, ক্রমশ দখল করে নেয় হৃদয়গগন। আবার কখনও বা নিজের ফুঁয়েই নিজে হাওয়া ভরা বেলুনের মতো অতিকায় হয়ে ওঠে। উদ্বেগ হয় অনাগত জীবন নিয়ে।
মাথার ওপর বনবন পাখা ঘুরছে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচমকা কলিং বেলে ঘুম ভাঙ্গলো। ঘরটাকে কেমন অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে গভীর সমুদ্রে নোঙর ফেলা কোন পরিত্যক্ত জাহাজে একা শুয়ে আছি। উঠে দরজা খুলে দিলাম। কাজের বুয়া খালা এসেছেন।
গত দু,দিন প্রচন্ড মন খারাপ। দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। মসজিদ পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে, মরছে মানুষ, মানবতা স্তব্দ। এত বড় মানবিক বিপর্যয়, কিছু ধর্মান্ধ মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ছে। কাঁদছে মানবতা।
বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ানো হলো, পানির দাম ও বেড়ে গেল।
অহনার থাকা না- থাকার মধ্যে কতগুলো তফাত আমি এখনই বুঝতে পারছি, সে অনুভুতি থেকে এক ধরনের অভাব বোধ তৈরী হয়েছে আর সেটা দারুন ভাবে স্পর্শ ও করছে আমাকে। মন যে কখন কী চায়, মনই কি জানে? এই যে সারাটা সকাল ধরে, সারাটা দুপুর ধরে, সারাক্ষণ ধরে শুধু অহনাকে মিস করেছি আজকে।
সিঁড়ির ল্যান্ডিং এর বাতিটা জ্বলছে না আজ। ফ্ল্যাট জুড়ে এক অখন্ড নৈঃশব্দ। খুব বেশী মিস করছি আমার প্রিয় নারীকে। অহনা কে। অহনা আমার কাছে অনন্ত সৌন্দর্যের আধার। এই সৌন্দর্যের কোন ও বন্ধন নেই। ঘাস ফুল লতাপাতা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের মত এও যেন এক প্রকৃতির বিস্ময়। সে বিস্ময়ের ঘোর আমার কাটছেই না।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট