ছযারা ধর্ম রক্ষার জন্য তাদের কন্যা ও স্ত্রীদের লেখাপড়া ও কাজে যোগদান বন্ধ করছেন, তাদের বলছিঃ বন্ধ করুন দয়া করে, জানেন কি আপনি কদিন বাঁচবেন? যেদিন থাকবেন না, সেদিন তারা চলবে কিভাবে? আল্লাহ চিন্তা দিয়েছেন, আল্লাহর নামে সে চিন্তা কাজে লাগান। নিজের জীবনের নিশ্চয়তা আপনার হাতে নেই তাহলে আপনি আরেক জনের জীবনে আপনার অনুপস্হিতিতে কিছু করে বেঁচে থাকার অবলম্বন কেন কেড়ে নিচ্ছেন?
২০২২ সালে এ লেখা লিখতে আমার ভাল লাগছে না বরং বাধ্য হচ্ছি। জন্মের পর থেকে দেখছি নারীর স্কুলে যাওয়া, কাজে যাওয়া সব নির্ভর করে তার পরিবারের মুরব্বী পুরুষ বা তার স্বামীর মর্জির উপর। কারণ আমাদের ধর্ম স্ত্রীর উপর স্বামীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ভালো কথা আমি আমার বাবাকে ও স্বামীকে এক মহাবিশ্ব পরিমান শ্রদ্ধা দিলাম তাই বলে আমার শিক্ষা কেন বন্ধ করতে হবে এবং আমার কাজে যাওয়া কেন বন্ধ করতে হবেঃ এই ২০২২ সালে?
আপনি কি জানেন আপনার আয়ুস্কাল কত? একজন মহিলার আয়ুস্কাল কত? যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তবে আয়ুস্কাল অনুযায়ী তার কাছাকাছি আয়ুতে আপনি আল্লাহর জান্নাতে চলে যাবেন। আমিন। যদি এক্সিডেন্ট হয় তখন আপনি অল্প বয়সে আল্লাহর জান্নাতে শোভা পাবেন। আমিন। কিন্তু যারা দুনিয়ায় থাকবে তারা কিভাবে চলবে? বেহেশত থেকে তাদের জন্য টাকা পাঠানোর সিস্টেম আল্লাহপাক চালু করেননি। তাহলে তারা কি করবেন? কতক্ষণ হাসানের “ আমার আল্লাহ নবীজির নাম” গান করে কান্না করবেন? কাঁদতে কাঁদতে তাদের ক্ষুধা লাগবে, খেতে হবে সেজন্য। সে খাবার কিনতে টাকা লাগে? কে দেবে টাকা তাদের?
আজ আপনি বেঁচে আছেন তাই যত দাপট ঘরের নারীদের উপর। তাদের পর্দা, প্রয়োজন সব আপনার কঠোর শাসন দিয়ে আপনি নির্ধারণ করছেন, আইন করে দিচ্ছেন-আপনার অনুমতি ছাড়া যেন সে বাইরে না যায়। সুবহানাল্লাহ! আপনার জান্নাতের নেশায় আপনি বুঁদ। জান্নাতের নেশা সাথে সমাজের প্রচলিত ধারাঃ আপনাকে সমাজ ক্ষমতা দিয়েছে, নারীর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে আপনার পুরুষত্ব জাহির করতে হবে। ঘরের বাইরে আপনি একজন শান্ত ভদ্র মানুষ যেই ঘরে আসলেন আপনার স্বৈরশাসন শুরু হয়ে গেল আপনার মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যা সন্তানের উপর। এদের যদি লেখাপড়া শেখান তবে কি একা এতো গুরুত্ব দেবে আপনার অনৈতিক স্বৈর নীতির? এ শংকায় আপনি তাদের উপর আরোপ করেনঃ পড়ালেখা বন্ধ নীতি, নারী শাসন ও শোষণের আপনার বেহেশতের সিঁড়ি নীতি – তাই আপনি ধার্মিক সহজে কি বেহেশত ছাড়বেন? মাশাল্লাহ!
চলেন পাশা উল্টাই। কি হবে কাল যখন আপনি বেহেশতে চলে যাবেন আর তারা দুনিয়ায় থাকবে? কোন মসজিদ তাদের বাজার করতে আসবে না, বাসার বিল দিতে আসবে না, আপনার স্ত্রী ও বাচ্চা অসুস্হ হলে তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে না? বেহেশত থেকে দূরবীন দিয়ে যদি দুনিয়ায় আপনি দেখেন তখন আপনি দেখবেন আপনার স্ত্রী আপনার বাচ্চাদের নিয়ে মাদার অফ ইন্ডিয়ার নার্গিসের মতো গান করছেন, “ দুনিয়া মে হাম আয়ে হে তো জিনাহি পরেগা, জীবন হে আগার জেহের তো পিনা হি পরেগা”? তখন আপনার কেমন লাগবে আমি জানি না।
যেজন্য আমার এ লেখাটি লেখা সেই মোদ্দাকথায় আসি। সেটা হলো মৃত্যু এক অমোঘ সত্য। একে ঘিরেই অনেক চিন্তা। কিছু অলীক এবং বাস্তব। বাস্তব চিন্তা হলোঃ আমি মরে যাবো সত্য কথা, আমার সৎ কর্ম নিয়ে আমি জান্নাত চলে গেলাম, আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু আমার পরিবারের যারা দুনিয়ায় বেঁচে থাকবেন তাদের দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে আমি বেঁচে থাকাকালীন সময়ে তাদের প্রস্তুত করা যেন আমার অবর্তমানে তারা এ দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারে, যেমন করে আমি তাদের প্রয়োজন পূরণ করতাম আমার শেষকৃত্য করার পর তাদের যেন বাড়ীর বিল দেবার ও প্রয়োজন পূরণ করার যোগ্যতা থাকে।
এ যোগ্যতাটিকে আমরা যারা অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ( FINANCIAL ADVISOR) হিসেবে কিছুটা কাজ করেছি এ পশ্চিমাদের দেশে আমরা বলিঃ জীবনের কঠিন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুতি ( Prepare for tough reality in life).
মৃত্যু জীবনের সবচেয়ে বড় কঠিন বাস্তবতা। আজ স্বচ্ছল একটি পরিবার, কাল পরিবারের কর্তার মৃত্যু পরিবারকে পথে বসায় কারণ আমাদের বেশীরভাগের এমন প্রস্তুতি থাকে না, অর্থনৈতিক অবলম্বন থাকে না, যেহেতু বাবা বা স্বামী সব প্রয়োজন পূরণ করতেন তাই স্ত্রী বা কন্যা এবং ক্ষেত্র বিশেষে মাও হঠাৎ করে কঠিন বাস্তবতার শিকার হন। এখন কি করার আছে আপনার? আল্লাহর মাল আল্লাহয় নিয়ে গেছে। ঠিক আছেঃ দোয়া পড়িঃ ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক। আমীন। তারপর দাফন, মিলাদ সব শোক শেষে ঘরের চুলা জ্বলতে হবে, বাজার করতে হবে, টাকা যদি আপনি যথেষ্ট রেখে না যান তবে কি করবেন আপনার পরিবার? তাদের জন্য উপার্জন ক্ষমতা তৈরী না করে কত টাকাই বা আপনি রেখে যাবেন? মরে গেলে হবে আবার সম্পদের ভাগাভাগি! এ সেই রকমের বিশাল ক্যাঁচাল- কতটুকু পাবে স্ত্রী, কন্যা বা মা বা বোন? যদি তারা উপার্জনক্ষম হয় তবে তারা আপনার অভাব থাকলেও আপনার জন্য কান্নাকাটি দোয়া দুরুদ পড়ার পাশাপাশি কিছু কাজ করে সংসারের অর্থনীতির হাল ধরে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবেন। তেমনউপার্জনক্ষম হতে হলে লেখাপড়ার বিকল্প নেই। তাই বাস্তবমুখী চিন্তা করুন, কন্যা, স্ত্রীকে স্কুলে পাঠান, উপার্জনক্ষম হতে সাহায্য করুন।আপনার এ চিন্তা দুর্দিনে আপনার অভাব মোচন করবে এবং তারা সারা জীবন সম্মানের সাথে আপনাকে স্মরণ করবে। ধন্যবাদ