পর্ব – ২২
বিকেল টা মরে আসছে ক্রমশ। বাসা ছেড়ে বেরিয়েছি সে অনেকক্ষণ আগে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে কত কত আজব ভাবনা মগজ জুড়ে ঘুরছে। ভাবনাকে বেশী গড়াতে দিলেই সমস্যা, মুশকিল। চলতে থাকবে, বইতে থাকবে, অনন্ত ধারায় বিভাজিত হয়ে ঢুকে পড়বে অচেনা অপ্রিয় খাতে। বালি সরিয়ে তুলে আনবে এমন সব স্মৃতি, যেগুলো মগজের খোপে মরে গেলেই খুব স্বস্তি পেতাম আমি। সামনে রাস্তাটা বড্ড ফাঁকা। দৃষ্টি বার বার চলে যাচ্ছে সামনের আকাশে, প্রায় অভ্যাসের মতোই দেখছি বিশ্বচরাচর। পশ্চিম দিগন্তে আজ অল্প অল্প মেঘ। জলহীন। শেষ সূর্যের রশ্মি মেখে গাঢ় রক্তিম। বিষন্ন এক আলো ছড়িয়ে আছে দু’ধারের মাঠে, ছুয়েছে গাছ গাছালিকে। দেখে মনে হয়, পাতলা রংজ্বলা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। বিস্তীর্ণ ভূমি বিচ্ছিরি রকমের ন্যাড়া এখন। বৈশাখের শেষ দিন আজ , এ যেন এক বিচিত্র বন্ধ্যা সময়।গত কাল বৃষ্টি হয়েছে তবু মনে হচ্ছে তৃষ্ণার্ত মাটি এখন বর্ষণের প্রতীক্ষায়।
ইদানিং কোন কিছুতেই আনন্দ পাচ্ছি না। আনন্দের জন্মদাতা কোষ গুলো কি চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে?
কয়েকজন রিকশাওয়ালা, কুলি কামিন গোছের লোক রাস্তার ধারে পর্দা টানানো চায়ের ঠেক টা ঘিরে বসে আছে, হেঁসে গড়াগড়ি খাচ্ছে একজন আরেকজনের গায়ে। এই সব লোক গুলো কে দেখে ভারী অদ্ভুত লাগে। এদের প্রত্যেকের জীবনকাহিনী প্রায় এক, সেখানে আনন্দের খোরাক নেই বললেই চলে। ঘরে নিত্য অনটন, গাদাখানেক এন্ডিগেন্ডি, ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই জুটে যায় হাড়ভাঙা খাঁটুনিতে, তবু যে এত পুলক আসে কোত্থেকে?? অশিক্ষা, অজ্ঞতা কি দুঃখবোধকে ভোঁতা করে দেয়?
হুস করে একটা টয়োটা এলিয়েন পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো। ধুলোর ঝড় এখন আমার চারপাশ ঘিরে। ধূলোয় মাখামাখি আমার সর্বাঙ্গ। ফুটপাতে উঠে পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফুসফুস তক্ষুনি নিকোটিনের বড্ড অভাব বোধ করছে। রোজা আছি তাই নিকোটিনের কামনা দমন করে জোরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে মনটা পুলকিত হয়ে উঠলো। নাকে তখন বেল-কামিনীর সুবাস। বিস্ময় বাড়ছিল আমার, এই ইট কাঠ আর পাথরের শহরে কেউ বাড়ীতে আজকাল কামিনী লাগায় নাকি? নাকি বাড়ীর মালিক ও আমার মতো স্মৃতিমেদুর? নাকি আমার মতো বুকে পুষে রেখেছে শুঁয়োপোকা, স্মৃতির নড়াচড়ার অনুভূতি?
মন থেকে ততক্ষণে নিকোটিনের শূন্যতা শেষ। ইদানীং বড্ড এড়িয়ে চলছি কাছের মানুষদের। গত কয়েক মাসে গায়ের চামড়া অনেক পুরু হয়ে গেছে, লোকলজ্জা আর তেমন গায়ে বিঁধে না এখন। কাছের লোকদের সমবেদনার ভারী ভারী নিশ্বাসই যা গোল পাকায়, বড্ড তেতো করে দেয় মেজাজ টা। আমার ছোট সংসারটায় আমি আর অহনা , একা একাই খুঁড়য়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের সংসার, আমি একা একাই নাড়াচাড়া করি আমার ঘেঁটে যাওয়া অতীত, একা একাই সাজাই ধূসর ভবিষ্যৎ।
বেশ ক’মাস ধরে আমার মনের সব জঞ্জাল ধুয়ে মুছে সাফ সুতরো করে মনের দরজায় আলপনা এঁকে ধীরে ধীরে মনের ঘরের চাবি টা নিজের আঁচলে বেঁধে দিব্যি আমার দখল নিয়েছে অহনা । ধাক্কা দিয়ে সরানো যাচ্ছে না কিছুতেই। শুধু মনে হচ্ছে আরও যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে আরো।
এমন একটা সময় সে আমার হৃদয়ের দখল নিয়েছে যে সময়টায় আমি মানসিক ভাবে ভীষণ একা। ভীষণ রকম একা। ভিতরে একটা ভয়ঙ্কর ক্রোধ, উঁহু শুধু রাগ নয়, একটা তীব্র আক্রোশ ও আমাকে দগ্ধাচ্ছে দিনরাত। যখন আমার মনে হয়েছিল আমি হেরে গেছি, চরম অপমানের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে, অথচ আমি কিছুই করে উঠতে পারছিলাম না। নিদেনপক্ষে নিজের মতো করে বাঁচার উপায় পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছি না। এই অসহায়ত্ব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল আমার জ্বালাপোড়া। কান্না পর্যন্ত আসে না তখন, টের পেতাম অশ্রুর উৎসটাই শুকিয়ে মরুভূমি….। তখনই সে এসে কড়া নাড়ে আমার হৃদয়ের ভেজানো দরজায়। কিন্তু সময়ের স্রোতে সে নারী আজ ঘরের মালিকানা সত্ত্ব নিয়ে নিয়েছে।
আমি রাস্তা ধরে হাঁটছি। আজো করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ইহধাম ছেড়েছ চৌদ্দজন। শ্যামলী গিয়ে একবারের জন্যও মনে হয়নি দেশে লকডাউন চলছে। লকডাউনে ও বরং শ্যামলীতে জ্যাম লেগেছে। বাহারি রংয়ের জামা জুতোর শপিং ব্যাগ হাতে নিশ্চিন্তে ওভার ব্রীজ পার হচ্ছে কয়েকজন। কেউ কেউ হতাশ চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের।
আমিও বেশ হতবাক হয়েই দেখছি আনন্দে শপিং করা মানুষ গুলোর চোখ চকচক করছে। তাদেরকে আমার পিশাচের মতো মনে হচ্ছে। কয়েকজন তো আবার পিপিই পড়েই শপিং করতে এসেছে। ভাবখানা এমন, তোরা যে যা বলিস ভাই আমার শপিং করা চাই ই চাই। যেভাবে আক্রান্তের এবং মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে তাতে এদের নাম নেই কি করে বলি?
হঠাৎ একদম রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশীর ভাগ মানুষেরই সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মানুষ গুলো নিত্য পন্য জোগাড়েই হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে শপিং নামের সোনার হরিণ তাদের কাছে অধরা প্রায়। গত দেড় মাসে অনেক শিল্প মালিক প্রোডাকশন কমিয়েছে, নয়তো কিছু কিছু বন্ধ হয়েছে। ছাঁটাই হয়েছে শ্রমিক, লক আউট হয়েছে কিছু কিছু। দেড় মাসেই বেকারে ভরে গেছে দেশ। তো এ মুহুর্তে শপিং করছে কারা? কিছু বড় লোক, মুনাফাখোর, দুনম্বরী করে পয়সা কামানো লোকজন, গরীবের রক্ত চোষা কিছু অমানুষ, কালো টাকার মালিক, অসৎ আমলা।
শ্যামলী স্কয়ারের সামনের ওভার ব্রীজের রেলিংটাকে চেপে ধরে অবাক চোখে রাস্তায় দেখছি লক ডাউনের মধ্যেই গাড়ীর ভিড়, মানুষের জটলা।
আকাশের রঙ পাঁশুটে। নীল দেখা যায় না। খুব ধূলো ওড়ে আজকাল। শুকনো দমকা হাওয়া বয়ে যায়। সেই হাওয়ায় আয় রোজগারহীন মানুষ গুলোর রুক্ষ চুল গুলো উড়ছে। মোড়ের মাথায় রাস্তা পার হচ্ছে কয়েকজন, চিন্তার রেখা তাদের কপালে স্পষ্ট। ওভার ব্রীজের রেলিংয়ে বসে ঝগড়া করছে কয়েকটা চড়ুই, কী নিশ্চিন্ত চড়ুই গুলো। আহা আমি যদি তাদের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারতাম?
সারা শরীরে ঘাম, কপালের ঘাম পড়ছে টপ টপ করে। এলো চুল ফেঁপে ছড়িয়ে আছে চারধারে। আয়নায় আমার পাগল পাগল চেহারার প্রতিবিম্ব পড়ছে। ফাঁকা ঘর। অহনা অফিসে। চার তারিখ থেকে ওর অফিস চলছে নয়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত। এ মাসে সিক্সটি পার্সেন্ট সেলারী দিয়েছে ওর অফিস। ফাঁকা ঘর। আমি আয়নার প্রতিবিম্বে নিজের দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসি। এই লক ডাউনে মাঝে মাঝে দুপুরটা আমার এরকমই কাটে। আবার শুন্য ঘরে অচেনা মানুষের শরীরের গন্ধ পাই। আমাদের কল্পনায় কথাবার্তা হতে থাকে। কত কথা আসে বুক জুড়ে। পাগল পাগল সব কথা, কাউকে বলা যায় না, কেবল তাকে বলা যায়। সে সব শোনে। আমি নির্লজ্জ শিশুর মতো মেঝেতে শুয়ে থাকি।
ইদানীং সংসার, ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব উদ্বেগ উৎকন্ঠা অহনার ভিতরে। কেন জানি না অহনার এই অস্থিরতার প্রচন্ড চেহারাটা আমার ভালো লাগে।
লকডাউনে থাকতে থাকতে গালের দাঁড়ি গোঁফ বেড়ে গেছে, চুল বেড়ে মাথায় হয়েছে জঙ্গলের মতো। নিজেকে দীন দরিদ্রের মতো মনে হয়। এই দীনদরিদ্র চেহারাটা কেবল আমার একার নয়, সারা ঢাকার। পার্কের গাছ গুলোর পাতায় ধূলোর আস্তর পড়েছে, পথে ভিখিরির সংখ্যা বেড়ে গেছে খুব। মুমূর্ষু এই ঢাকা শহরের নিঃশব্দ চিৎকার ভিখিরিদের গলায় উঠে আসছে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট