পর্ব-৫৮
দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসে । বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে । সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত । মিহি সরের মতো জোৎস্না কতদিন দেখি না । কত দিন মিহি সরের মতো জোৎস্না লুটিপুটি খায় না ,আমাদের বিছানায় । দুপুর গুলোকে এখন বড়ই ছোট্র মনে হয় । এই আসে এই যায় । নিদালি ছড়িয়ে রাত ঘুম পাড়ায় পুরো ভূবনকে । ইদানিং দুপুর মানেই আমার কাছে এক অস্ফুট কামনা । অহনার আসার । অহনা আসলে আমার কেবল মনে হয় থেমে থাক । সময়টা থেমে থাক । রাত আসে ব্যালকনির অপরাজিতা আর মাধবী লতায় আপনমনে দোল খায় হাওয়ারা । দুপুরে শুতে পারিনা শুলেই গা ম্যাজ ম্যাজ করে , মাথা ভার হয়ে অস্বস্থি লাগতে শুরু করে । মনটা সকাল থেকেই খচ খচ করছে । অহনা কখন বেরিয়ে গেল টেরই পাইনি । গতকাল শুক্রবার ছিল । সকাল থেকেই অহনা ঘরের পর্দা ঝাড়া , নতুন বেড কভার পেতে বিছানা ঝকঝক করে রাখলো । টবে থাকা আর্টিফিসিয়াল ফ্লাওয়ার গুলো ঝাড়মোছা করে তারপর ক্ষ্যান্ত হয়। আমার সংসার চারদিক থেকে অহনাকে অক্টোপাসের মতো খামছে রয়েছে । কোথাও যাবার জো নেই । ছয়দিন অফিস একদিন ছুটি । ছুটি পেলেও কাজ আর কাজ । আমার ঘরের সদর দরজার মতো অহনাও কোথাও নড়তে পারে না । রাগ , দুঃখ অভিমান সব তাকে চার দেয়ালে পুষে রাখতে হয় । নিজেই সংসারের সব কাজ করছে , অপটু হাতে রান্নাবান্না করছে । সংসারে দশ জনের মনকে বোঝা অসম্ভব । একজনের মনকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে কি পারেন? প্রথম প্রথম হয়তো সবাই চেষ্টা করে । তারপর শুরু হয় মানিয়ে শুনিয়ে চলা । সন্ধ্যায় একটা সাইন্টেফিক সিম্ফোজিয়াম ছিল রেডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেনে , অহনা কে নিয়েই গেলাম । অহনা কে নিয়ে সব খানে যেতেই আমার স্বাচ্ছন্দ্যটা একটু বেশী । আর আমি তো পুরো মেশিনের মতো হয়ে গেছি । যেন একটা নিয়মে বাঁধা যন্ত্র । কবে থেকে যে জীবনটা এমন হয়ে গেল টেরই পাইনি । মাঝে মাঝে অহনাকে বলতে ইচ্ছে করে তুমি আমাকে আগের দিনের মতো একটা রঙিন দিন উপহার দিতে পারো ? কিন্তু আর বলা হয় না ।
শ্রাবণের সকাল বেশ ঘন হয়ে গেছে । অহনা অফিস চলে গেছে । চোখ ঘষতে ঘষতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম । রোদ এতো ঝলমলে যে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছে । মেঘ বৃষ্টির কোন দেখা দেই , শ্রাবণ মাসে ও আকাশ রীতিমতো ঝকঝকে নীল । যেন বর্ষা নয় শরৎ কাল চলছে । থমথম চতুর্দিক । উত্তাপ বাইরে থেকে মৃদু ভাবে ঢুকে পড়েছে ঘরে ।ঘরে ফিরে এলাম , গোটা ঘর নিঝুম । গাঢ় থমথমে ভাব চেপে বসেছে আমার বুকে । কলিং বেল বাজছে । কাজের খালা এসেছে বোধ হয় । দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলেন । মুখের হাবভাব একটু যেন শিথিল । ঘড়িতে সবে সাড়ে এগারোটা । রোদ্দুরটা বড় চড়া ।শহুরে মানুষ হাঁশফাঁস করছে গরমে । নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে লোডশেডিংয়ের । তাবৎ দুনিয়া গরমে পুড়ছে । দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে লোকালয়ে । মানুষ প্রকৃতির ওপর যে পরিমানে জুলুম করেছে কয়েক দশকে প্রকৃতি এখন সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছে । সরকার কারনে অকারনে ক্ষ্যাপাটে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে , মানুষকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা বলছে কিন্তু সরকারী দফতরের লাখ লাখ এসি অকারনে চলছে , আমি বুঝিনা কোট টাই পড়ে কেন অফিস করতে হবে ? জরুরী দফতর ছাড়া অন্য দফতর গুলোর অফিস আওয়ার কমিয়ে দিলেই তো হয় । একটা বাজে খিদে পাচ্ছে অল্প অল্প । আকাশে জমতে শুরু করেছে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ঢাকনা । মিথ্যা অজুহাতে সনাতনীদের ওপর হামলে পড়ছে ধর্মান্ধ চক্র । কোন প্রতিকার নেই । সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা জারি রাখতে হবে আমাদের । আগামী দিনে কী হবে আমাদের কর্মপন্থা সেটা নিয়ে বসা দরকার আমাদের , সময় বয়ে যাচ্ছে মৌলবাদীরা সংগঠিত হচ্ছে আর আমরা প্রগতিশীলরা পড়ে আছি ভ্রান্ত আর অভ্রান্ত নিয়ে । প্ল্যান অব অ্যাকশন নিয়ে আমরা প্রচুর সময় ব্যয় করছি কিন্তু সাধারন মানুষের মনোভাব আমরা খেয়াল করছি কি ? আমাদের প্রতি ? ধর্মান্ধ পান্ডারা রীতিমতো আমাদের বিরুদ্ধে মানুষের কাছে বিষোধগার করছে ।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাতের চা টা শেষ করলাম ।ক’দিন খুচরো খাচরা বৃষ্টির কারণে আজ গরম টা বেশ প্যাচ প্যাচে । গায়ে জল ঢেলে আরাম হলো বটে কিন্তু বাইরে বেরোতেই আবার ছটফটানি । ফ্যানের হাওয়া গায়েই লাগছে না ।
অহনা শুয়ে আছে । শুক্রবার অহনার প্রচুর কাজ থাকে । এদিকে বুয়া ও ডুব মেরেছে । বিয়ে খেতে গেছে তিনদিন হলো আসার কোন লক্ষনই নেই । দুপুরে খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছে । মুঠো ফোনে দেখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম । ওদিকে আমাকে যেতে হবে পার্টি অফিস । সম্পাদক মন্ডলীর মিটিং চলছে সেন্ট্রাল কমিটির । তবে আমি যাব অন্য কারণে আমাদের পার্টির আর সংগঠনের একটা টিম সুনামগঞ্জের দিরাই – শাল্লাতে যাব রাতে ত্রাণ সহায়তা আর মেডিকেল টিম নিয়ে । মেডিকেল টিম যাচ্ছে আমার নেতৃত্বে তাই কি কি ঔষধ নিতে হবে তার একটা তালিকা করে দিতে হবে । রাস্তায় জ্যাম একদম নেই । পার্টি অফিসে যাওয়ার পর ঠিক হলো কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম , সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল ইসলাম জুয়েল , সমাজকল্যান সম্পাদক শাহীন ভূইয়্যা যাচ্ছে আমার সাথে । রওয়ানা হবো রাত পৌনে এগারোটায় । পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম চিলতে মেঘে ঢাকা পড়েছে সূর্য্য , ভারী মায়াময় আলোয় সেজে উঠেছে ঢাকা নগরী । মনোরম একটা বাতাস লাগছে গায়ে । বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এলো । মোটর সাইকেল গ্যারেজে রেখে আনমনে সিঁড়ি বেয়ে কখন যে পৌছে গেছি ঘরের দরজায় । লম্বা একটা সময় একটা অভিমানে রাজনীতি থেকে দুরে ছিলাম ছাব্বিশ বছর আগে যখন পার্টি ভাঙল তখন খুব ব্যথিত হয়েছিলাম । মানুষের ভালো করতে এসে নিজেদের মধ্যে লড়াই , এরচেয়ে কুৎসিত আর কী আছে ! সব্বাই একই আদর্শে বিশ্বাসী । একটা শোষনহীন সমাজ দেখতে চায় । অথচ মতে সামান্য অমিল কিংবা ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার দ্বন্ধে একে অন্যের শত্রু । ব্যক্তিগত দ্বন্ধের জেরেই নিজেদের লক্ষ্য থেকে ছিটকে যাচ্ছি আমরা আর বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সামন্ত আর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল গুলো সেটা লুফে নিয়ে কুৎস্যা রটিয়ে জনগনকে বিচ্ছিন্ন করছে আমাদের থেকে । ফুসফুস নিংড়ে একটা বাতাস বেরিয়ে এলো । শিথল পায়ে ঘরে ঢুকলাম । সঙ্গে সঙ্গেই বুকটা ছলাৎ । হ্যাঁ হৃদয়ে ঢেউ তোরার মতোই সাজ গোজ করেছে অহনা । সালোয়ার কামিজের বদলে পরনে আজ মেরুন রং শাড়ী , শুকনো শুকনো মুখখানায় সুষমা এনেছে প্রসাধনে । মাপসই ওষ্ঠরঞ্জনী , কপালে ছোট্র মেরুন টিপ আর খোলা চুলে সে যেন অন্য মানবী আজ । একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসছে ।অহনা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । হাসি হাসি মুখ করেই জিজ্ঞেস করলো তোমাদের যাওয়া কয়টায় ?
দুর থেকে যেমন শ্যামল সুন্দর দেখায় , জায়গাটা আদতে অতটা সুন্দর নয় । সমুজের যেটুকু সমারোহ তা কেবল হাওরের পাড় ধরেই । যেখানে মেডিকেল ক্যাম্প হবে জায়গাটা একটা মন্দিরের চাতাল । দুর থেকে জায়গাটা যতটা সবুজ মনে হয়েছে জায়গাটা তত সবুজ নয় । মধ্যি খানে গাছপালা আছে বটে তবে তা মোটেই ঘন নয় । ছাড়া ছাড়া । ছ্যাকরা ছ্যাকরা । যেখানে মন্দির তার আশে পাশে কিছু বাবলা , জারুল , শিমুল অপরিকল্পিতভাবে রোপন করা হয়েছিল কখনও , সেগুলোই বেড়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । বাঁশঝাড় আছে কয়েকটা । পুরো জায়গাটা জুড়েই জেলেরা মাছ নিয়ে বসে আছে । হরেক রকম মাছ । হাওড়ের । এমন কিছু নয়নাভিরাম দৃশ্য নয় । বহতা জীবনের মতোই জোলো , অনাকর্ষণীয় । প্রচন্ড রোদের তেজ টিমের সকলেই ঘামছি দরদর । কিছুক্ষন আমি , মাসুম এলোমেলো ঘুরলাম । জেলেদের সঙ্গে খানিক গল্প জুড়লাম । স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও বদলায় নি দিরাই – শাল্লার মানুষের জীবন । সাতাশ বছরে ভেবেছিলাম অনেক কিছু হয়তো বদলেছে কিন্তু কই হাওড়ের অসহায় মানুষের জীবনের কিছুই বদলায় নি । দুঃখেই যাদের আনন্দ তাদের দুঃখ কে খন্ডাবে ? এদের আনন্দগুলো দুঃখ মিশ্রিত । বন্যায় এদের সব ভেসে যায় আবার খরায় সব পুড়ে যায় । দিরাই – শাল্লার কাস্তে মার্কার প্রার্থী কমরেড নিরঞ্জন খোকন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেন , কমরেড জায়গাটা ভালো লাগছে ? ভালোমন্দ মিশিয়েই তো মানুষের ভাললাগা । ভালো না লাগাটা এক ধরনের অসুখ । আমাকে এখনও ওই রোগে ধরেনি , আমি হেসে জবাব দেই । ওহ , তারমানে আপনি এনজয় করছেন । আমি হাসি । উপভোগ না করলে যে খারাপ লাগতেই হবে তারও কোন মানে বোধহয় নেই । মেডিকেল ক্যাম্পে আমি , জুয়েল আর পার্টির কয়েকজন কমরেড । মাসুম , খোকন আর শাহিন গেছে ত্রাণ বিতরনে । তিন , চার ঘন্টা একটানা বানভাসি মানুষদের চিকিৎসা ঔষধ দিয়ে উত্তর- পশ্চিম কোণে চোখ পড়তেই ঈষৎ সন্ত্রস্ত বোধ করছি আমি । জুয়েল কে বললাম , মাসুমকে ফোন দাও আকাশের অবস্থা ভালো না । আচমকা একটা দমকা হাওয়া তারপর পুরো চরাচর স্তব্দ , গুমোট । ঝড় ওঠার লক্ষন ততক্ষনে ত্রানের টিম ফিরে এসেছে । ট্রলারে ঊঠে বসেছি আমরা । আকাশ চিরে বিদ্যুৎ নেমে এলো , আরেকটা উলটোমুখো খ্যাপা বাতাস শুরু হলো । এক লহমায় ঝুপ করে কমে গেল দিনের আলো । মেঘের আবরণে নেমে এল আঁধার । গাছেরা সব ঝাঁকুনি খেয়ে উন্মাদের মতো দোলাচ্ছে মাথা । হাওড়ের পানিতে জেগে থাকা হিজল আর করচ । হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ।
দেড় দু ‘ ঘন্টার দুরত্ব দিরাই । এই ঝড়ের তান্ডব আর ঢেউয়ে ভেসে ফিরতে পারব তো ! আঁধার নেমে গেল । কানে তালা লাগিয়ে একটা বাজ পড়ল । পরক্ষনে আরেকটা । হাওয়ার বেগ কমেছে সামান্য , কিন্তু মেঘের গুড়গুড় ধ্বনি যেন চড়ছে ক্রমশ । পড় পড় শব্দে বড় বড় কয়েকটা ফোটা পড়ল গায়ে । কিছু ভাবার আগেই দাপট বেড়ে গেল বৃষ্টির ।মাসুম বলে ঊঠল , এ তো মহা বিপদ হল । বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বোটের গায়ে । তখনই পাক খেয়ে আমাদের বোট আটকে গেল ডুবো চরে । ঢেউ আর ঝড়ের দাপটে মাঝি মাল্লারা জলেও নামতে পারছে না । কী হেল্পলেস সিচুয়েশন । আমাদের কিচ্ছু করার নেই । আশে পাশে কয়েক মাইলের মধ্যে বাড়ীটাড়িও নেই যে গিয়ে উৎপাত করবো । কি হবে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে …. অন্ধকারে …. না মাথা কাজ করছে না । মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে যদি সলিল সমাধি হয় তবে কালকের নিউজ চ্যানেল গুলোর হেডলাইন কি হতে পারে ! বনার্তদের ত্রান আর চিকিৎসা দিতে এসে নৌকা ডুবিতে মৃত্যু কয়েক যুবকের ? নাকি অন্য কিছু । সবাই মোবাইলের টর্চ জ্বানিয়ে অন্ধকার দুর করার চেষ্টা করছে । একই দাপটে ঝরছে বারিধারা । প্রায় আধ ঘন্টা পর মাঝি সমেত দুজন নেমে পড়ল জলে , দশ মিনিটের চেষ্টায় ইঞ্জিন বোট ভাসল হাওড়ের জলে । ভেতরে বসে টের পাচ্ছি ইঞ্জিনের গোঙানি । দুরে , বহুদুরে দু’কুচি ক্ষীণ আলোর পথ দেখে এগুচ্ছে বোট গুঙিয়ে গুঙিয়ে ঢেউ ঠেলে । একটু স্বস্তি বোধ করছি সবাই । চলছে বোট অসহায় বিপন্নতার শঙ্কা কমলো খানিকটা । বাইরে থেকে আসা অবিরল বৃষ্টির ধ্বনি যেন এই মুহুর্তে বিপদের সংজ্ঞাটাই পালটে দিয়েছে । অহনার মুখটা মনে পড়ল কয়েকবার । মোবাইলের স্ক্রিণে থাকা ছবিটা দেখছি বার বার । বাড়ির কথা কি মনে পড়ল একবার ? এই মুহুর্তে ? হয়তো না । বর্তমানের বিপন্নতা বুঝি মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্মৃতিহীন করে দেয় । চকিতে চোখের সামনে ভেসে উঠল রাহা রাহীর মুখ ।আমি কিছুই ভাবছি না , শুধু চরম অস্বচ্ছন্দ এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে আছি । বোটের গলুইয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বৃষ্টি কমে গেছে । বড্ড অন্ধকার , দুঃসহ অন্ধকার । মাসুম ফেসবুকে বিপদে পড়ার কথা স্ট্যাটাস দিল , পার্টির কমরেডরা সবাই ক্ষনিক বিরতিতে ফোন দিচ্ছে । সময় কাটছিল নিজের মনে । অথবা কাটছিল না । আবার বৃষ্টি এলো , একই লয়ে আক্রমন করে চলছে হাওড়ের জলে । আমরা বোটের ভেতর এসে বসলাম । বাইরে বৃষ্টির ঝাঁঝ বাড়ল হঠাৎ । বোট আবার আটকালো ডুবো চরে । মাসুম অসহিঞ্চু হয়ে বকছে মাঝি কে । একটা আনাড়ি মাঝি ! একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আমার । বোটের ভেতর স্যাঁতস্যাতে বাতাসে মিশে গেল দীর্ঘশ্বাস টা কেউ টেরই পেল না ।
রাত বারোটার একটু আগে এসে নৌকা ভিড়লো দিরাই । শ্রাবণের আকাশ তখনও কেঁদেই চলেছে তবে এখন একটু গুমরে কাঁদছে বোধ হয় । প্যাকেটে থাকা শেষ সিগারেট টা ধরিয়ে টান দিয়েছি । মনে হলো পৃথিবীতে অনেক দিন বাঁচবো । পৃথিবীটাকে বড়ই পবিত্র লাগছে । পৃথিবীর সব জঞ্জাল ধুয়ে সাফ হয়ে গেল বুঝি । শরীর জুড়ে অচেনা শিহরণ , আশ্চর্য অনুভুতি । নিরঞ্জনের ডেরায় ফিরে এলাম । গোটা দিরাই ঘুমাচ্ছে অঘোরে । সব খাবার হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে কখন ! অবশেষে নিরঞ্জনের ডেরায় আয়োজন হলো খিঁচুড়ি আর ডিমের । যাচ্ছেতাই রান্নাটা অমৃত মনে হলো । বেশ বেলাতেই ঘুম ভাঙলো আমাদের । চারদিকে রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে । ঝকঝকে নীল আকাশ । কে বলবে কাল সন্ধ্যার ঝড় বৃষ্টিতে প্রায় মরতেই বসেছিল সমাজতন্ত্রের জন্য , শোষণমুক্ত দেশ দেখার স্বপ্নে বিভোর কয়েকজন যুবক ।
ঢাকার বাসায় সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আচমকা মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে পাঁচ বছরের পাকা পাকা কথা বলে যাওয়া , ঠোঁট ফোলানো অভিমানী , আহত চোখে তাকিয়ে থাকা রাহির মুখ । হঠাৎ একটা যন্ত্রণা কুরে কুরে খায় আমায় । সব বাবারই কি এমন হয় ? নাকি আমার মত বাবাদেরই শুধু ? প্রিয় সম্পদ হারিয়ে ফেলার পর তার অভাব দ্বিগুন চতুর্গুন হয়ে বাজতে থাকে বুকে ।
মধ্য রাত্রি অহনা হয়তো ঘুমাচ্ছে । দরজার সামনে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে কলিং দিলাম , খুট করে দরজা খুলে গেল । অহনা কি দরজাতেই ছিল ? ও কি জানত আমি এসে গেছি ? নাকি আমার পায়ের আওয়াজ বড্ড পরিচিত ওর । দরজা খুলে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে ফ্রিজের ঢালা খুলে বের করলো ওয়াইনের খালি বোতলে রাখা ঠান্ডা জল ।বারো মাস ফ্রিজের ঠান্ডা জল খেতে হয় আমার । আশ্চর্য একটা জলপ্রপাত তুষারের স্তুপ হয়ে বুকে জমে থাকার পরও । সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি । চাঁদ উঠেছে । চাঁদ ওঠার পর অন্ধকার অনেক মিহি । দুরে কয়েকটা বাসার জানালায় আলোর ফুটকি । জেগে আছে মানুষ আমার মতো বুকে তুষারের জলপ্রপাত নিয়ে ? আকাশে পাতলা মেঘের স্তর থাকায় চাঁদের দীপ্তি ছড়াচ্ছে না । নিঃসীম জ্যোৎস্না মিলিয়ে গেল চোখের জলের পর্দার ওপারে । চোখের দু কূল ছাপিয়ে গেল । যন্ত্রনায় নুয়ে পড়ছি , যেন এক ক্লিন্ন, ন্যুজ বৃদ্ধ ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট