ছোটবেলায় বাবা মার মুখে শুনেছি, যে যেমন কর্ম করে সে তেমন ফলভোগ করে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রমাণ খুব একটা দেখি না।দেখা যায় অনেক চোর ইচ্ছামতো চুরি করে বুদ্ধির জোরে বা অন্য কোনো কৌশলে অনেকেই পার পেয়ে যায়।কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোর যে শাস্তি পায় না, এমন নয়।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী শাস্তি পেয়েছেন বলে দেখা যায় না। আবার অনেক পরিশ্রমী ও ভালো মানুষকে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে দেখা যায়। আবার কিছু পরিশ্রমী ভালো মানুষকে পুরস্কৃত হতেও দেখা যায়।
কিন্তু আমার নিজের বেলায় সেসব মানে “যেমন কর্ম তেমন ফল” দেখতে পাই না। উদাহরণ হিসেবে শুরু করি
দাঁতের আলোচনা দিয়ে। পান খাওয়া আমাদের পৈতৃক ঐতিহ্য। আমার ঠাকুরদাদার আমল থেকেই বাড়িতে পান খাওয়ার চল।ছোটবেলায় কাঁচা সুপুরি খেয়েছি বটে, কিন্তু পানাভ্যাস আমার কোনদিনই হয়নি।কিন্তু আমার চার ভাইবোনের সকলেই পানে রীতিমতো আসক্ত বলা যায়।কেউ কেউ পান খাবার কোনো প্রতিযোগিতা থাকলে রীতিমতো পদক পেতেন, তা আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি(সংশ্লিষ্টদের কাছে ত্রুটি মার্জনার প্রার্থনা করি)। কিন্তু তাদের কারও দাঁতেই উল্লেখযোগ্য কোনো সমস্যা নেই। এমনকি একজনের বয়স প্রায় ৭৭ হলেও এখনো গোটা সুপারি দিয়ে কড়মড়িয়ে পান খায়।কিন্তু দাঁতের সমস্যা হলো আমার। বেশ কয়েকবার ফিলিং করিয়ে ঠিক না হওয়ায় ২০১১/২০১২ সালে ঢাকায় দুটো দাঁতে রুট ক্যানেল করাই।পরে সমস্যা হলে ২০১৫ সালে এবং অপরটি ২০২০ সালে উঠিয়ে নেই। সেসময় ডেন্টিস্ট জানান, কোনো দাঁতেই রুট ক্যানেল ছিল না,কেবল ক্যাপ লাগানো ছিল।
সেটা অবশ্য আজকের লেখার বিষয়বস্তু নয়।আজকের বিষয়বস্তু, যেমন কর্ম তেমন ফল।কেউ কেউ বলতে পারেন, কেবল পান না খেলেই হবে না,আরও অনেক সতর্কতা মেনে চলতে হয়।তাদের উদ্দেশ্যে লিখি,১৯৯৬ সালে বড়ছেলের দাঁতের সমস্যা হলে প্রথম ডেন্টিস্টের কাছে যাই।তখনই প্রথম দাঁতের স্কেলিং করাই।এরপর মাঝেমধ্যে দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেছি। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী সম্ভব সবকিছুই করেছি। তারপরও দাঁত আমায় ভুগিয়েছে।
২০০৯ সালে আমার রক্তে শর্করা দেখা গেলো। এরআগে আমাদের পরিবারে কারও ডায়াবেটিস ছিল না।মা বাবার অসুখের সময় পরীক্ষা করে কখনো এ রোগের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। তখন অবশ্য আমার ওজন কিছুটা বেড়েছিলি এবং মানসিক শান্তিও বিঘ্নিত হয়েছিল।কিন্তু আমি ১৯৯৩ সাল থেকে সকাল বা বিকেলে হাঁটতে যেতাম।প্রথম সন্তান পেটে আসার পর আমার স্ত্রীকে হাঁটার পরামর্শ দিলে তাকে নিয়ে নিয়মিত প্রথমে পার্বতীপুর উপজেলা এবং পরে দিনাজপুর জেলা শহরের রাস্তায় হেঁটে চলাচল করতাম। এমনকি তখনই টেনিস খেলা শুরু করে অল্প কিছু বিরতি দিয়ে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত লন টেনিস খেলেছি। মাঝে মাঝে টেবিল টেনিস, শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলেছি। অর্থাৎ বলতে চাইছি, আমি একেবারে চেয়ারে বসা কাজ করা মানুষ নই,নিয়মিত শরীরচর্চা করেছি। কিন্তু আমারই ধরলো ডায়াবেটিস। অনেককে দেখেছি অফিস, বাসার বাইরে কোনো শারিরীক কসরত না করে, তিনবেলা পেটপুরে মাংস,মাছ,ভাত খেয়ে দিব্বি সুস্থ আছেন। এমনকি অনেকের মেদ আমার চেয়ে কম।সিরাজগঞ্জে আমি দু’বেলা হাঁটতাম। (সেখানে টেনিস কোর্ট এ কোনো বিচারক তখন না যাওয়ায় এবং সিরাজগঞ্জের যমুনার ধারে হাঁটতে ভালো লাগার জন্য )।সেখানে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে তিনি বলেছিলেন, আমার চেহারায় হাঁটার কোনো প্রতিফলন নেই।তিনি যথার্থই বলেছিলেন।
অবসরে যাবার পরে থেকে বলতে গেলে বাড়িতেই আছি। মাঝেমধ্যে কোথাও ঘুরতে গেছি মাত্র।বাড়িতে এতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, যারা দেখেছেন তারা জানেন। যারা জানেন না,তাদের জন্য বলি।আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ। সেখানে কখনো সবুজ, কখনো সোনালি ঢেউয়ের খেলা। এর কিছুটা পূবেই রয়েছে একটা মোটামুটি বড়ো বিল (সাতবিল)।পিছনে রাস্তা, রাস্তার কিছুটা পশ্চিমেই বাঙালি নদী। সেখানে বর্ষাকালে প্রচুর জল হয়,সারাবছর জল ও স্রোত থাকে। যত গরমই হোক বাড়িতে তেমন গরম অনুভূত হয় না।তবে বেশি শীত পড়লে কিছুটা সমস্যা হয়।
প্রতিদিন ভোরে উঠে হাঁটতে যাই।আগে এক ঘন্টা হাঁটলেও এখন ৪৫ মিনিট হাঁটছি।হেঁটে এসে চিয়া সিড খাই,আগের রাতে ভিজানো ছোলা, বাদাম খাই।হাল্কা গরম জলে লেবু মিশিয়ে খাই।কাঁচা রসুনের কোয়া আর আদা খাই। সকাল ৯ টার দিকে সাধারণত লাল আটার রুটি, সব্জি এবং একটা ডিম খাই।বেলা ১ টা থেকে দেড়টার মধ্যে দুপুরের খাবার খাই।সাধারণত মাছ,ভাত এবং শাক সব্জি থাকে। সপ্তাহে একদিন হয়তো চর্বি ছাড়া মাংস খাই।দুপুরের খাবারে ঘরে বানানো টকদই থাকেই।টকদই কখনো ভেজানো সিয়া বীজ বা শসা দিয়ে খাই। সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যেই রাতের হাল্কা খাবার খাই।সে খাবারে বেশিরভাগ সময়ই থাকে চিড়া, খই,যবের ছাতুর সাথে একটা শবরি কলা, আর কিছু সর ছাড়া দুধ।আগে দশটার দিকে ঘুমাতাম। ইদানিং নটাতেই শুয়ে পড়ছি।অবশ্য বিশ্বকাপ শুরু হলে ভিন্ন কথা। তখন খেলা শেষ হলেই ঘুমাতে হবে।
যা বলতে চাইছি একদম নিয়ম মেনে আদর্শ জীবন পদ্ধতি বেছে নেয়া সত্বেও অসুখ বিসুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না।নিয়মিত ডাক্তার দেখাই,স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাই,নিয়ম মেনে পরামর্শ অনুযায়ী অষুধ খাই।শুধু ডাক্তার নয়,অন লাইনে যে যে পরামর্শ পাই,তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার চেষ্টা করি।আমার স্ত্রী মাঝে মাঝ আমাকে পরিহাস করে বলেন,আমি অনুগত ছাত্র,যে যা বলেন তা মেনে নিই।হ্যাঁ, এটা আমার একটা চারিদিক বৈশিষ্ট্য বা দুর্বলতা। কিন্তু এতোসব করে কী লাভ হলো! এক ক্যান্সার আর উচ্চ রক্তচাপ ছাড়া হেন অসুখ নাই,যা আমাকে স্পর্শ করেনি।
লেখক- অরুপ গোস্বামী, সাবেক জেলা দায়রা জজ, কুষ্টিয়া।