উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার একজন ফল বিক্রেতা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দুর্নীতির প্রতিবাদ হিসেবে। এই ছোট্ট ঘটনাটি সমগ্র তিউনিসিয়া তো বটেই আফ্রিকা ছাড়িয়ে আরব বিশ্বে তীব্র কম্পনের জন্ম দেয়। ফলশ্রুতিতে ‘আরব বসন্ত’ নামে এক বিদ্রোহের সূচনা হয়। তিউনিসিয়ার বিদ্রোহ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মিশর, লেবানন, বাহরাইন, লিবিয়াতে দাবাণলের মত ছড়িয়ে পড়ে আরব বসন্ত। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির সঙ্গে আরব বসন্তের মিল অমলি দুই-ই আছে।
আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোতে একনায়করা বছরের পর বছর দেশ পরিচালনা করে গেছে। এই সময়কালে তরুণ সমাজ পৃথিবীর বাকী সবার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে আবিস্কার করেছে পরাধীন হিসেবে। শাসকদের রক্ষণশীলতা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, সমাজে ধনী গরীবের বিস্তর তফাত এইসব তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে। বলা হয় হলিউডের তারুণ্য সিনেমা দেখেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তে সহায়তা করেছিল। তরুণ্য বঞ্চিত হতে চায় না।
মিশরের কথাই ধরা যাক। মিশরে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে আরব বসন্তে ছাত্র বিক্ষোভে যোগ দেয় মুসলিম ব্রাদারহুডসহ ইসলামী জিহাদী গ্রুপ সকলেই। হোসনী মোবারকের সময় মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বলা যেতে পারে মিশরের জামাত ইসলাম হচ্ছে এই মুসলিম ব্রাদারহুড। এই ব্রাদার হুডের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ মোরসি আমেরিকা থেকে লেখাপড়া করে আসা উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে আশির দশকে মিশরে তিনি ফিরে এসে মিশরের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। ব্রাদারহুডের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি নানা ছদ্ম পরিচয়ে ইসলামী রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তার ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন। ১৮ দিনের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে হোসনি মোবারকের পতন হলে মুসলিম ব্রাদারহুড বিপ্লবের প্রধান ভাগিদার হিসেবে লাইমলাইটে চলে আসে। মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মোরসি ৫১.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়। মনে রাখবেন মোরসি মাত্র ৪ শতাংশেরও কম ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছিল। মোরসির বিপক্ষে ভোট মিশরকে কোনদিন ইসলামী চরমপন্থাদের হাতে দেশ চলে যাক সেটা চায় না। ফলে আরব বসন্তের বড় রকমের ধাক্কা শুরু হয় মোরসির বিজয় থেকে। মোরসি মিশরকে হোসনি মোবারক থেকে উন্নত তো দূরের কথা মোবারকের মত করেও দেশ পরিচালনা করতে পারেননি। ফলে জনগণকে সংবিধান সংশোধন, সংস্কার এইসব কর্মসূচী দিয়ে দৃষ্টি ঘোরাতে চেষ্টা করে। তার ক্ষমতার এক বছর পূর্তী উপলক্ষ্যে আনন্দ উদযাপনের ঘোষণার দিনে তাহরী স্কোয়ারে এক লাখ জনতা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই তাহরী স্কোয়ারেই হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে জড়ো হয়েছিল জনতা। ২০১৩ সালে মোরসিকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতায় নেয় সেনা প্রধান সিসি। বর্তমানে তিনিই মিশরের প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশের সঙ্গে মিশর তিউনিসিয়া লিবিয়ার মিল অমিল এখানেই। শেখ হাসিনা একনায়কতন্ত্র কায়েম করে তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা জনতার ক্ষোভকে ইসলামিক চরমপন্থিরা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিল। মিশর বা তিউনিসিয়ার সঙ্গে অমিল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জয়ী হয়ে আসা দল। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি দল। বাংলাদেশে এখনো এই দলের সমর্থকরা বিপুল। হোসনি মোবারক, গাদ্দাফি বা তিউনিসিয়ার জয়নাল আবেদিনদের ছিল না তেমন কোন রাজনৈতিক দলের উত্তরাধিকার বা ঐতিহ্যগত সমর্থক। মিশরের আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষ তরুণদের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল মুসলিম ব্রাদারহুডরা। মোবারকের বিরুদ্ধে এক হয়ে তারা লড়াই করেছিল। বাংলাদেশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে সাধারণ ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন বলে ঘর ছাড়া করে এনে সরকার পতনের একদফায় পরিণত করার সময় এই আন্দোলনের অর্ধেক সমর্থক তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এখন বৈষম্য বিরোধীদের সারাদেশের কমিটি দেখলেই বুঝা যায় এখানে বিএনপির কোন সমর্থক নেই। এখানে শিবির ও বিভিন্ন চরিত্রহীন বামপন্থী ও ইসলামিক জিহাদীদের পরিচয় গোপন করা সদস্যরা বসে আছে। ফলে দেশের ৯৫ ভাগ রাজনৈতিক মাঠ যাদের দখলে সেই বিএনপি-আওয়ামী লীগ আসলে এই বৈষ্যমহীন কমিটির কোন প্রতিনিধিত্ব করে না। মিশর বা তিউনিসিয়ার সঙ্গে এখানেই কোন মিল নেই। বৈষ্যম বিরোধী ছাত্র কমিটি মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি রাজনৈতিক মুখপাত্র হয়ে আছে। এই তাসের ঘরটি সিসির মত কোন সেনা শাসকের এক ফুঁ-তেই উড়ে যাবে। সেক্ষত্রে আওয়ামী লীগের হারানোর কিছু নেই। বিএনপির হারানোর অনেক কিছু আছে।
আজকের এই বাংলাদেশকে আরব বসন্ত বলার কোন সুযোগ নেই। এখানে একনায়কতন্ত্রের অবসান মানুষ চেয়েছে কিন্তু অনৈতিক-অরাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কেউ চায়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আক্রমন আক্রোশ বিএনপি-আওয়ামী লীগের বিপুল সমর্থকদের কাছে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সংবিধান সংশোধনের পক্ষে চোখ বন্ধ করেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোন রায় নেই বলা যায়।
লিবিয়াতে গাদ্দাফি একটা খচ্চরের জন্ম দিয়েছিল নাম ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’। পুরো আরব দেশকে সমাজতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র দিয়ে কব্জা করতে গাদ্দাফি দুটো মূলো ঝুলিয়েছিল আরবদের কাছে যে মুলোগুলো খেতে তারা সব সময় পছন্দ করে। ‘পশ্চিমা অমুসলিমরা মুসলমানদের খেয়ে ফেলবে’ আর ‘ইসলাম’ হচ্ছে সেই মুলো। ফলে গাদ্দাফি পশ্চিমা বিরোধীতা ও সমাজতন্ত্রের আগে ইসলাম বসিয়ে দিয়েছিল। গাদ্দাফি তার খচ্চরটিকে পাকিস্তানে চড়ে বেড়াতে জুলফিকার আলী ভুট্টকে দায়িত্ব দেন। বিনিময়ে পাকিস্তান প্রচুর ভিক্ষা পায়। লাহোরে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একটি স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয় গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। গাদ্দাফির খচ্চরটিকে বাংলাদেশে পেলেপুষে রাখার জন্য আহমদ ছফাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। গ্রীণ বুক নামের একখানা বই অনুবাদ ও প্রচার দায়িত্ব নিয়ে ছফা দেশে ফিরে আসেন অনেক টাকা পয়সা নিয়ে। তসলিমা নাসরিন বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে লজ্জা উপন্যাস লিখেছে- এই অভিযোগ ছফা করলেও বাস্তবে লিবিয়া থেকে তার কাছেই টাকা এসেছিল। খেয়াল করে দেখবেন কমিউনিস্ট আর ইসলামিস্টরা আমাদের মত যারা আছেন, তাদেরকে মোসাদ, র’ থেকে টাকা আসার অভিযোগ করে। বাস্তব হচ্ছে কমিউনিস্টদের জন্য আগে রাশিয়া চীন থেকে টাকা আসত। আরবদের থেকে তো ইসলামিস্টদের জন্য এখনো টাকা আসে। বিদেশী এজেন্টদের থেকে যারা মাসোহারা খায় তারাই রাতদিন মোসাদ, র থেকে টাকা খাওয়ার অভিযোগ করে!
যাই হোক, এই ইসলামী সমাজতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রসার লাভ করেছে। এদের জামাতের দলে ফেলা যাবে না। এদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলাদা ন্যারেটিভ আছে। সেখানে আওয়ামী লীগ ভারত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের খলনায়ক। তাদের ভাষায় সেদিন ‘বেহাত হয়েছিল বিপ্লব’! এই অংশটি এন্টি আওয়ামী লীগ। এদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ইসলামপন্থি শক্তিই ছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আন্ডারগ্রাউন্ড মাস্টারমাইন্ড। তারাই কোটা আন্দোলন বলে প্রতারণা করেছিল দেশের সমস্ত স্কুল কলেজের ছাত্রদের। তারাই একটি অরাজনৈতিক ডাকে সবাইকে ঘরছাড়া করেছিল। তারাই লাশের অপেক্ষায় বসেছিল। এরাই এখন কমিটি করে কিংস পার্টি করতে চাইছে। যাদের একটা কলেজ ছাত্র সংসদ চালানোর যোগ্যতা নেই তারাই এখন রোজ জাতিকে ব্রিফ করছে! এরা এখন ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। দেশের ভোটের হিসেবে ৯৫ শতাংশ এদের সঙ্গে নেই। সেনাবাহিনী উঠে গেলে এদের পরিণতি ভেবে আমি শংকিত!
আরব বসন্ত কি দিয়েছে আরবদের সেই প্রশ্ন আরবরাই করুক। আমাদের কি দিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান সেই প্রশ্ন করা উচিত। শেখ হাসিনা তার পতনের রাস্তা খুড়ছেন ২০১৪ সাল থেকে বলে আসছি। তার প্রতিটি কাজের সমালোচনা করে বলেছি তার পতন কেবল তার দলের পতন হবে না, বাংলাদেশের পতন হবে। শেখ হাসিনা কখনোই হোসনি মোবারক বা গাদ্দাফির মত হবেন না। তার জনসমর্থন বিপুল। কিন্তু কি লাভ হবে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার স্বপ্ন দেখে? শামিম ওসমান যদি লীগের থেকে আবার এমপি হয় তাহলে কেন আবার আওয়ামী লীগকে দেশের ক্ষমতায় দেখতে চাইবে মানুষ? এরকম কত শত ওসমান পরিবার আছে লীগের গডফাদার হিসেবে? শেখ হেলাল, হাসনাত, ওবাইদুল কাদের এরাই যদি আওয়ামী লীগ হয় তাহলে আওয়ামী লীগ তার পতন থেকে কোন আত্মসমালোচনা করেনি। নিজের ভুল সে দেখতে পায়নি। গণতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাস না করে ২১ আগস্ট ঘটিয়ে বিএনপি চরম মূল্য দিয়েছে। লীগকে তারচেয়ে বেশি দিতে হবে। সেই মূল্য দীর্ঘ হবে যদি না তারা নিজেদের পরিবর্তন না করে। যুগের দাবী তাদের মানতে হবে। দেশটাকে জেলখানা বানিয়ে রাখলে সেই শাসকের পতনের জন্য তরুণরা ঘরছাড়া হবেই। এটাই তারুণ্যের ধর্ম। জুলাইয়ে তারা প্রতারিত হয়েছে। তাই বলে ভবিষ্যতেও তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে না এটি ভাবার কারণ নেই। তাই, বিএনপি-আওয়ামী লীগ, নিজেদের বদলান। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে হটানোই বড় কথা নয়। ব্প্লিবের পরের দেশ পরিচালনাই আসল কথা। বাংলাদেশে সবার আগে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের একশোভাগ নিশ্চিত শাসনযন্ত্র প্রয়োজন। ভাবুন। চিন্তা করুন।