নেপালের মধ্য প্রদেশের ওউরাহি গাও পালিকা (গ্রামীন পৌরসভা) এর ৫নং ওয়ার্ডভূক্ত সাফিটোল (রজক পল্লী) তে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২৪ মে, ২০২৪ শুক্রবার দুপুর ১২.১৫ টায় স্থানীয় ‘রাজদেউড়ি দলিত মহিলা কৃষক সংগঠন’ এর নেত্রী শান্তি কুমারী রজক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় অংশগ্রহন করেন গবেষণা সংস্থা ‘সমতা ফাউন্ডেশন’ এর কর্মকর্তা গোপাল নেপালী, দলিত মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী (ডিএইচআরডি) সন্তোষ বিষুনকে, ডিএইচআরডি রামসেবক মাহারা, বাংলাদেশের নোরেক ফেলো ও সংগঠক শিপন কুমার রবিদাস এবং মিতা হাজং।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মতামত প্রদান করেন ‘রাজদেউড়ি দলিত মহিলা কৃষক সংগঠন’ এর সদস্য মঞ্জু কুমারী সাফি, সানজিলা সাফি, লালিতা দেবী সাফি, আশা দেবী সাফি, সারকি দেবী সাফি, রামপারি সাফি, ছেত্রি দেবী সাফি, নিনম কুমারী সাফি, শীলা দেবী সাফি, তুলো দেবী সাফি, ফুলকুমারী সাফী, বিনতা সাফি, শান্তী সাফি, সীতা সাফি, ধর্মন্তী সাফি, রাধা সাফী, ললিতিয়া সাফি, লালিত সাফি, স্বজন সাফি, লালতি সাফি, পরমিলা সাফি প্রমুখ।
পরিচয় পর্বের পরপরই দলিত মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী সন্তোষ বিষুনকে তার বক্তব্যের মাধ্যমে ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং দলিত জনগোষ্ঠীর উপর এর বিরূপ প্রভাব’ বিষয়ে আলোকপাত করেন। এসময় আলোচনায় অংশগ্রহনকারীগণ উন্মুক্তভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। জানা যায়, স্থানীয়রা ‘রাজদেবী (আরাধ্য দেবী)’ এর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল এবং বিশ^াসী। তাদের বিশ্বাস- প্রাকৃতিক বিপর্যয় রাজদেবীর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির উপরে নির্ভর করে। কিন্তু সন্তোষ বিষুনকে এই ধারণা সঠিক নয় বলে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেন। সরকারের কৃষি বিভাগের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে চলমান সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি সবাইকে বুঝান।
দলিত মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী রামসেবক মাহারা উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করে বলেন, আপনাদের চলমান সমস্যা কি? প্রতিত্তুরে অংশগ্রহনকারীগণ বলেন, বন্যার কারনে চাষাবাদের এলাকাসহ সর্বত্র পানিতে ডুবে যায়। ফলে জীবনযাপন করা খুবই কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও দলিত মানবাধিকার, নারী অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সংক্রান্ত বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে স্থানীয় গাও পালিকায় যোগাযোগ করতে হবে বলে মনে করেন রামসেবক মাহারা। তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি বীমা চালু করেছে সরকার। ক্ষেতে চাষাবাদ করতে করতে কোনও কৃষক মারা গেলে ১ লাখ টাকা দেবার নিয়ম চালু রয়েছে। গরু-ছাগলের নামেও বীমা করা যায়।’
দলিত মহিলা কৃষানী মঞ্জু কুমারী সাফি বলেন, ‘দলিতদের যদি ইটের ঘর থাকে, সরকার (গাও পালিকা) তাদের দলিত হিসেবে সুযোগ-সুবিধা দিতে চায় না। তারা তো আর জানেন না, ইটের ঘরের মধ্যেও কত-শত কষ্ট বিদ্যমান।’
আলোচনায় জানা যায়, ওউরাহি সাফিটোলে ৪২ ঘর রজক পরিবারের বসবাস। তন্মধ্যে ১৩টি খড়ের ঘর। ৫০০ এর অধিক রজক পরিবার ০৫ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। শিক্ষা-দীক্ষা, কারিগরী দক্ষতায় এখনও অনেকটাই পিছিয়ে সাফি জনগোষ্ঠী। এ জনগোষ্ঠীর মাঝে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথা ব্যপক। মোটর সাইকেল/ সাইকেল যৌতুক দেওয়ার রীতি আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে ‘ডে-খাজা’ (মিড ডে মিল) চালু আছে। এখানকার দলিতদের ঘরোয়াভাবে মাদক তৈরীর নজির কম, দোকান থেকে কিনে সেবন করার রীতি রয়েছে। সাফিদের ঘরকা দেওতা (ঘরের ইষ্ট দেবতা) হলো: কালী, বানী, গড়াইয়া এবং বাহারকা দেওতা (ঘরের বাইরের দেবতা) হলেন: ডিবার বাবা, রাজদেবী ইত্যাদি। অদলিতরা জাত-পাত মানে পূজার সময়, তারা দলিতদের থেকে পূজা-পার্বণের সময় যথাসম্ভব দুরত্ব বজায় রাখে।
সাফিদের মধ্যে বেকারত্ব তুলনামূলক কম বলা চলে। তবে অনেকেই ৫-৬ লাখ টাকা ঋন করে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গেছে। সাফিদের মধ্যে বিদেশগামীতা বাড়ছে, দেশে আয় কম। নিজস্ব পুঁজি না থাকায় ঋন করে বিদেশ যায়। ভূমিহীন দলিত কৃষানীরা অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। সাফি পুরুষরা ঘরের বাইরে বিভিন্ন কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করে সংসারে অবদান রাখেন। তাদের কারো কারো বাড়ি নিজের জমিতে নয়, সরকারী খাস। ঘরবাড়ি ভঙ্গুর। কন্টাক্ট ফার্মিং (লিজ হোল ফার্মিং) এর মাধ্যমে গাও পালিকায় আবেদনের মাধ্যমে জমি নিয়ে চাষাবাদ করে থাকেন অনেকেই। সাফিদের বংশ-পরম্পরায় পেশা কাপড় ধৌত করা হলেও তা এখন বিলুপ্ত প্রায়। এ কাজের চাহিদা অনেকটাই তলানিতে পৌঁছেছে। হাতে-গোনা কতিপয় সাফিদের স্থানীয় বাজারে লন্ড্রি দিতে দেখা যায়। ফলে এক রকম বাধ্য হয়েই তারা বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তনের দিকে বাধ্য হয়েই ঝুঁকছে। এ বিষয়েও তাদের অনিশ্চয়তার ছাপ চোখে-মুখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
আলোচনান্তে আগামীতে গাও পালিকায় উত্থাপনযোগ্য সুপারিশসমূহ:
খরার কারনে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস, এ বিষয়ে গাও পালিকার দৃষ্টি আকর্ষন।
পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
‘শিবমূলম তালিম’ (দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ) সরকারীভাবে ব্যবস্থা করতে হবে।
জাত-পাত বৈষম্য দূর করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সভাশেষে একটি প্রতিনিধদল স্থানীয় ৫নং ওয়ার্ড পালিকার চেয়ারম্যান রামপ্রিত যাদব মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে সুনির্দিষ্ট দাবীনামা উপস্থাপন করলে তিনি ন্যায্য দাবী পূরনে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট