আজ ১ মার্চ । স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ অকুতোভয় শহীদ কমরেড তাজুল এর মৃত্যুবার্ষিকী । তাঁর সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি জানাই বিপ্লবী শ্রদ্ধা…….লাল সালাম।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবমুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ দৃঢ়চেতা অকুতোভয় যোদ্ধা শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম ছিলেন “আদমজী মজদুর ট্রেড ইউনিয়ন” এর নেতা এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আদমজী শাখার সম্পাদক। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ৫ দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তীব্র গণআন্দোলনের সময় অসীম সাহসী শ্রমিকনেতা, শ্রমিকদের প্রিয় তাজুল ভাই স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডাদের হাতে শহীদ হন। রাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজজীবনে সন্ত্রাস, কালো টাকা ও সুবিধাবাদের যে ঘৃণিত প্রক্রিয়া চলছে, তার বিপরীতে শহীদ কমরেড তাজুলের সততা, আদর্শ, দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স, কমরেড তাজুল ইসলাম ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি’র সিদ্ধান্ত অনুসারে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করার মহান ব্রত নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন আদমজী জুট মিলে বদলি শ্রমিক হিসেবে। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবী জীবন। আদমজীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। কমরেড তাজুল নিজের মতাদর্শগত চেতনায় এবং পার্টির নির্দেশে স্বৈরাচারবিরোধী হরতাল সফল করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু এক মহান মৃত্যু। কিন্তু তাঁর জীবনসংগ্রাম আরও মহান। তাজুলের মতো এক ঝাঁক শিক্ষিত তরুণ নিজের ব্যক্তিগত জীবন তুচ্ছ করে সমষ্টির মুক্তির জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে– এটাই যুগের দাবি। একটি শোষণমুক্ত সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার লড়াই এগিয়ে নিতে তরুণ সমাজকেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে— এর কোনো বিকল্প নেই।
কুমিল্লা জেলার মতলব থানার ইছাখালি গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের ছেলে তাজুল শৈশবে মাতৃহারা হয়ে আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলার জন্য ঢাকা শহরে গৃহভৃত্য ও আইসক্রিম বিক্রির কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রবল প্রতিকূলতা তাজুলের শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ দমাতে পারেনি। মামার অভিভাবকত্বে শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হন। তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৬ সালে মতলব হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ৩টি লেটারসহ প্রথম বিভাগে এবং পরবর্তীকালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাজুল ইসলাম ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী ছাত্র গণসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে ১৯৬৮ সালে তাজুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্ন গণসংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে তাজুল মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অধ্যয়ন শেষ করে কমরেড তাজুল সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৪ সালে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন এবং প্রধান কর্মক্ষেত্র হিসেবে দেশের তৎকালীন বৃহত্তম আদমজী জুট মিল বেছে নেন। এদেশের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে নিবেদিত করেন। একপর্যায়ে বেসিক ইউনিয়নের কমিটিতে ২৫ শতাংশ বহিরাগত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থাকার আইন বাতিল হলে তাজুল আদমজীতে সাধারণ শ্রমিকের কাজ গ্রহণ করেন। স্ত্রী ও দু’সন্তান নিয়ে একদিকে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, প্রতিকূল পরিস্থিতি, ভয়ভীতি; অপরদিকে সচ্ছ্বল জীবনের সুযোগ ও হাতছানি। কিন্তু কোনো কিছুই তাজুলকে তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
১৯৮৪ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী ১১টি শ্রমিক সংগঠন (পরবর্তীকালে স্কপ), ১৫ দল ও ৭ দল আহুত হরতালের সমর্থনে আগের দিন মধ্যরাতে আদমজী জুটমিল এলাকায় কমরেড তাজুলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা প্রচার মিছিল বের করলে, তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর হামলায় কমরেড তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন শ্রমিক মারাত্মক আহত হন। ১ মার্চ ভোরবেলা গুরুতর আহত অবস্থায় কমরেড তাজুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
শহীদ কমরেড তাজুল— লাল সালাম।
(শাহনেওয়াজ কবির পাপ্পুর ফেসবুক থেকে)
