পর্ব-৩৭
অহনাকে পেয়ে সব দুঃখ ভুলে আছি আমি। অহনাই তো প্রথম ভালোবাসতে শেখাল, নতুন করে স্বপ্ন দেখাল, জীবনের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনল আবার। অহনা এখন আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। জীবনের অনেকটা সময় তো কাটিয়েছি ভেসে ভেসে।
জীবনটা ছিল একটু অন্যরকম। অন্যরকম? কী রকম? শত চেষ্টা করেও আজো সে উত্তর মেলাতে পারিনি। গলা জুড়ে চাপা মেঘ কেবল জমা হয়ে যায়। নিজেকে বোঝাতে চাওয়ার থেকেও না বুঝতে দেয়ার কষ্ট অনেক বেশি। তার জন্য যে কী ভয়ানক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় নিজের সঙ্গে। নিরন্তর জবাবদিহি করতে হয় নিজের কাছেই। কেন এমন হয়?সব কিছুই কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগত। কিছ একটা পেতে মন চাইত, যেন আরও কিছু পাওয়ার ছিল আমার। কী সেটা? কী? ভরাট শান্ত দিঘির মতো টলটলে সুখী সংসার? হুম সেটাই। সে আক্ষেপ টা ঘুচিয়ে দিয়েছে অহনা এসেই।
ধুলো উড়ছে শুকনো বাতাসে। বড় নিশুত, নিঝুম চারদিক। বিছানায় শুয়ে চোখ স্থির হলো অহনার ছবির ফ্রেমে। হাসি হাসি মুখের আমার অহনা। মনে হল অহনার খিলখিল হাসি ভেসে ভেসে ছড়িয়ে আছে নির্জনতায়। ছড়াতে ছড়াতে পৌঁছে গেল একদম আমার বুকের মাঝখানটাতে। এখানে আর কেউ পৌঁছাতে পারে না। রীতি, নিয়ম, সমাজ সংসার কেউ না। এই মুহুর্তে অহনার একটা গভীর স্পর্শ কামনা করছে আমার মন। আমার দেহ। আমার বলিষ্ঠ হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার ইচ্ছের ঢেলা এখন অফিসে। হেমন্তের ভরা বেলা এখন বেশ গম্ভীর, এলোমেলো হিমেল হাওয়া বইছে হঠাৎ হঠাৎ। সে হাওয়ায় ঝরে পড়ছে অজস্র শুকনো পাতা। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম, অজান্তেই একখানা উঠে এল ঠোঁটে। চাগিয়ে উঠেছে নেশাটা। করোনা না ঢুকলেও খানিকটা করে বিষ ঢুকছে ফুসফুসে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী একসময় বন্ধু ছিল, তারপর প্রেমিকা আর এখন বউ। অহনা মাঝে মাঝে বলে সিগারেট না ফুঁকে কাজ করো। আরে বাবা ত্রিভঙ্গমুরারি হয়ে সিগারেট ফোঁকাটাও তো একটা কাজ। সিগারেটের শেষটুকু বাগানের ওপাশে ছুড়ে দিয়ে তুম্বো মুখে দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়।
অঘ্রাণের দুপুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। একটা মলিন রোদ বিছিয়ে আছে শহরের গায়ে। বাতাসে সামান্য শিরশিরে ভাব। পুবমুখো ঘরের সামনে একফালি বারান্দা। সকালের রোদ বারান্দাতেই থমকে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিন শুকিয়ে ফ্যাকাশে মেরে যায় ঘরের ভেতর। এদিকের জানালা দুটোর পর্দা তুলে রাখলে দু’ফালি আকাশ তবু যা হোক ছিটে-ফোঁটা আলো ছিটিয়ে দেয়।কত তুচ্ছ কারণের অনুষঙ্গে কত কী যে মগজের ভান্ডারে জমে থাকে মানুষের! কী ভয়ংকর মিসম্যাচ ছিল আমার জীবন। যেমন করে তাতল আঁচে এঁটেল মাটির হৃদয় শুকায়, শাঁস মরে, আঁশ মরে, তারপর গোটা অন্তর পোড়াফাটা, তেমনি ভাবে দিনে দিনে বুকের ভেতরটা খাক হয়েছিল আমার। শূন্য ঘর। নিষ্প্রভ আলো। এইতো গত সপ্তাহে অহনার অফিসের কয়েক কলিগ মিলে ওরই অফিস কলিগ ইমা আপাদের গ্রামের বাড়ী নবাবগঞ্জ ঘুরতে গিয়েছিলাম। অহনা গাড়ী কিংবা বাসের নাম শুনলেই বমি করতে শুরু করে গাড়ীতে উঠলে তো আর কথাই নেই। ওর বাবার বাড়ী যাবার সময় গাড়ীতে উঠেই বমির ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম মেরে যায়। এমন অবস্থা হয় যে হঠাৎ করে কেউ দেখলে মনে করবে জামাই বুঝি সারা রাস্তা কেলাতে কেলাতে নিয়ে এসেছে। কোন ঔষধেই কাজ হয়না। ব্যাপার টা মানসিক। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত।
ওর প্রায় সকল অফিস কলিগই বেশ জলি। আর আমার সাথে একটু বেশীই জলি। সায়মা এলো ওর বর আর মিষ্টি মেয়েটাকে নিয়ে। সায়মার বর মিরাজ দিলখোলা মানুষ। আর জাকারিয়া ওরফে জ্যাক সর্বদা দিল খোলা, তবে বিয়ের কথা বললেই কেন যেন চুপ করে যায়। সবাই গাড়ীতে বসতেই পলকে গোটা পরিবেশটাই বদলে গেল। ছুটির দিন জ্যামজট আর যানজটের বালাই নেই। এখন অবশ্য ভিড়ের সময় নয়। করোনার জন্য স্কুল কলেজ বন্ধ তার ওপর শুক্রবার। গাড়ী ছুটছে দুরন্ত গতিতে। জ্যাক গান চালিয়ে দিয়েছে। বাইরে সূর্য আড়মোড়া ভাঙছে, হাই তুলছে, তাপ ছড়ানোয় মন নেই। কথা বলতে বলতেই কখন যে এসে গেল। ইমা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় ওর বাবাকে সাথে নিয়ে। ভদ্রলোক স্কুল মাস্টার। সৌম্য শান্ত চেহারা। তবে চেহারায় কেমন যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার একখানা ভাব আছে।ইমা আপার মা ও শিক্ষিকা, মনে হলো সযতনে লালন করছেন সন্তানদের আর সংসারের সমস্ত চাবির গোছাটা খুব শক্ত করে গুছিয়ে রেখেছেন। খালাম্মার প্রতিমার মতো মুখ। আমার অবাক হবার আরেকটা কারন হলো সাজানো গুছানো ইমাদের বুকসেলফ। বহু বছর পর গ্রামে কারো বাড়ীতে এত সুন্দর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী দেখলাম। ওদের বাড়ীর পাশেই পানাপুকুর, সবুজাভ জল। সায়মার মেয়ে হইচই করছে জলে নামার জন্য। অহনা ঘরে বসে রইলো, সবাই পুকুর পাড়ে এসেছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলো না। হইহই করে ছুটে এলো।ও পুকুরের ঢালাই বেঞ্চিতে এসে বসল। ক্ষনে ক্ষনে দামাল বাতাস এসে এলোপাতাড়ি জড়িয়ে ধরছে, চুল টুল সব উড়ে একসা। সিদ্ধান্ত হলো দুপুরের ভূরিভোজনের পর দল বেঁধে মৈনাক ঘাটে যাওয়া হবে।
ভূরিভোজনের আকার দেখে আমি তো অবাক। বিফ বিরিয়ানী ইলিশ ফ্রাই সহ ম্যালা আইটেম। দই মিষ্টি কিছুই বাদ পড়েনি সাথে কোল্ডড্রিংস। সূর্য হেলছে পশ্চিমে কচি শিশুর মতো কেবল লেপ্টে আছে আকাশে। হই হই করে আবার সবাই মৈনাক ঘাট, কেউ আবার নাম দিয়েছে মিনি কক্সবাজার। মৈনাক ঘাটে নেমে মনে হলো স্বর্গদ্বারে বুঝি এসে গেলাম। দাঁড়াতেই মাতাল পদ্মা একেবারেই মুখোমুখি। নীলাভ জলে উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে মাথার ওপর দিয়ে ঢলে পড়ছে সূর্য, হীরের কুচি মেখে ঝিকমিক করছে জল, বালি আকাশ পৃথিবী। ভেজা বাতাসের ঝাপটানিতেও কী বিবশ মাদকতা! ইস, নদীর ঢেউগুলো কী ভীষণ দূরন্ত। অবিরাম নাচতে নাচতে আছড়ে পড়ছে তীরের বুকে। ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই, মাতামাতি চলছে তো চলছেই। যতদুর চোখ যায় শুধু জল আর জল। সাদা জল আকাশের ছায়া পড়ে গাঢ় নীল। জেলে নৌকাগুলো দূরে বিন্দু বিন্দু লাগছে। মনে হয় যেন তুলিতে আঁকা ছবি। জ্যাক আর মিরাজ ভাই স্পিডবোট ঠিক করছেন। দূরে একটা চর জেগেছে সেখানে যাবেন সবাই মিলে। অহনা চুপচাপ মুড়িওয়ালার বেঞ্চিতে বসা। হাই তুলছে। স্পিডবোটে উঠে অহনা উচ্ছল। চরে পৌছে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, -আহ মারভেলাস। আমি আর এখান থেকে যাবনা। এখানেই থেকে যাব। সবার চরে নেমে চোখের আড়াল অহনা লেপ্টে আছে আমার হাত ধরে। আমিও চুপিসারে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম, আদর করো আমায়। ভালোবাস, শুধু আমাকেই ভালোবাস, অহনা মাতালের মতো তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। বিকালের শেষ সূর্যের অালোকচ্ছটায় ওকে অপ্সরীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে কোন মৎস্য কুমারী,কিংবা দেবী ভেনাস এই মাত্র জলের তলদেশ থেকে উঠে, এল বুঝি।
কতটা সময় যে বয়ে গেল কে জানে! ব্যালকনি দিয়ে একটা নরম ঠান্ডা হাওয়া এল ঘরে, ঘুরপাক খাচ্ছে। ইদানিং ও খুব বাচ্চা বাচ্চা করছে। মেনেসট্রসন হলেই ও খুব ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাচ্ছে। খুবই স্বাভাবিক মেয়েরা মা হতে না পারলে আপসেট হয়ে যায়। কিন্তু ওর আপসেট মুখচ্ছবি আমার কোন কালেই পছন্দ না। লোকে বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি একঘেয়ে, কি জানি হয়তো! একটা মানুষের তো অজস্র চেহারা থাকে। কিন্তু আমি আর অহনা একসাথে তিনটি সম্পর্ক মেনে চলছি, কখনো আমরা বন্ধু, কখনো আমরা প্রেমিক প্রেমিকা, আবার কখনো স্বামী- স্ত্রী। একটা সম্পর্কে একঘেয়ে লাগলে আরেকটায় ডাইভার্ট হয়ে যাচ্ছি। উল্টে পাল্টে সম্পর্কটাকে উপভোগ করার মজাটা অহনাই আমাকে শিখিয়েছে। এক ছাদের নীচে ,এক বিছানায় হাজার রাত কাটিয়েও নিকটতম মানুষের কত কিছু যে গোপন থেকে যায় । অহনা আমার কাছে খোলা বইয়ের মত। আমি আর অহনা আমরা দুজনেই কাজ করি। আমি চিকিৎসক আর স্ত্রী একটা গ্রুপ অফ কোম্পানীতে ।জানেন রান্নাও দুজনেই করি বাইরের কাজ ও। আর এর পরে নিজের নিজের দুনিয়াও আছে এবং ওর বন্ধু আমার বন্ধু রা সব এক হয়ে পার্টিও করি। তথাকথিত সংসার কন্সেপ্ট বিলুপ্ত করতে না পারলে পারিবারিক সহিংসতা কিংবা অশান্তির সমস্যা থেকেই যাবে। কন্যা আগে জীবনে প্রতিস্থিতা হোক , ১৪ জন কে রেধে বেড়ে খাওয়াবার দায়িত্ব তার একার নয়, আর সবার খরচ সবকিছুর একটি ছেলের একার দায়িত্ব ও নয়। এইভাবে সব সঠিক নিয়মে চলবে । প্রথাগত সংসার করতে ভালো লাগে না আমাদের। প্রতিটি মেয়েরই আর্থিক স্বনির্ভরতার প্রয়োজন আছে ,আজকের নিষ্ঠুর সমাজে ভীষণভাবেই আছে ।কিন্তু যাঁরা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নন, অথচ শরীর নিংড়ে সংসারের জন্য খাটেন , তাঁরাও কিন্তু স্বনির্ভর মেয়েদের থেকে একচুল পিছিয়ে নেই । হ্যাঁ , নেই ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট